Bangladesh

যেভাবে ফারইস্ট লুট করে নজরুল খালেক গং

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি। একসময় গ্রাহক চাহিদার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকলেও আজ বীমার টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আর এই সবই হয়েছে কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ বেশ কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতির কারণে। কোম্পানির সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. হেমায়েত উল্লাহ, ব্যাংকিং ইনচার্জ শেখ আব্দুর রাজ্জাক, কোম্পানি সেক্রেটারি এম এ আজিজ, অডিট হেড কামাল হোসেন হাওলাদার, আইটি হেড মাজেদুল ইসলাম, হিসাব ইনচার্জ কামরুল হাসান খান, উন্নয়ন কর্মকর্তা নূরুল্লাহ সিদ্দিকী ও নজরুল ইসলামের পিএস আজহারুল ইসলামের যোগসাজশে বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে জমি কেনা, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ নেয়া এবং ক্ষতিকর বিনিয়োগ করে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে তারা। যার হিসাব দিতে না পেরে দুদকসহ একাধিক মামলার আসামি হয়েছেন নজরুল-খালেক গং। 

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ-আইডিআরএ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। এর বাইরে আরও ৪৩২ কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ফারইস্ট লাইফ ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে। এসব জমি কেনা হয় বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। ৭টি জমি কেনা ও ভবন নির্মাণ এবং বালু ফেলার নামে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯৯ কোটি টাকায় কেনা হয়েছে বলে হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাস্তবে এ জমি কেনা হয়েছে ১৯ কোটি টাকায়। ১৯৯ কোটি টাকার মধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে চেকে দেয়া হয়েছে ৬৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা এসোসিয়েটকে চেকে দেয়া হয়েছে ৪০ কোটি টাকা এবং রেজিস্ট্রেশন খরচ বাবদ চেকে দেয়া হয়েছে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেয়া হয়েছে নগদে। কোম্পানির ৭২ নং কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশান নর্থ এভিনিউর জমি কেনায় ৮৯ কোটি, গুলশানের আরও ২টি জমিতে ৮০ কোটি এবং বরিশালের আলেকান্দায় একটি জমি কেনায় ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এসব জমির দলিল ঘেঁটে দেখা গেছে, কাকরাইলের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের শ্বশুর মো. মফিজুল ইসলাম ও স্ত্রীর ভাই সেলিম মাহমুদের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাছলিমা ইসলামকে ১১৫ কোটি টাকা উপহার দেন মফিজুল ইসলাম ও সেলিম মাহমুদ। তাছলিমা ইসলাম আবার সেখান থেকে ৫০ কোটি টাকা উপহার দেন তার স্বামী নজরুল ইসলামকে। তোপখানা রোডের জমি কেনা হয়েছে নজরুল ইসলামের বন্ধু নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের দুই সহোদর মো. সোহেল খান ও মো. আজাহার খানের কাছ থেকে। আর মিরপুর চটবাড়ির নিচু এলাকার জমি কেনা হয়েছে ২০ জন বিক্রেতার কাছ থেকে। বীমা আইন অনুযায়ী ৫ হাজার টাকার বেশি হলেই ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে লেনদেন করার আইন থাকলেও এসব জমির মালিকদের সকলকেই নগদ টাকা দেয়া হয়েছে। 

অপরদিকে এমটিডিআর বন্ধক রেখে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নজরুল-খালেক গং। এর মধ্যে এম এ খালেক, প্রাইম প্রোপার্টি, প্রাইম ফাইন্যান্স, ম্যাকসন্স, মিজানুর রহমানের নামে বন্ধক রেখে ৫৪২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। ফারইস্টের এমটিডিআর বন্ধক রেখে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির নামে ১৬৪ কোটি, পিএফআই প্রোপার্টিজের নামে ১৬০ কোটি, ফারইস্ট প্রোপার্টিজের নামে ১৫১ কোটি, প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ৯২ কোটি, মিথিলা প্রোপার্টিজের নামে ৬৪ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজের নামে ৫৫ কোটি, মিথিলা টেক্সটাইলের নামে ৪৮ কোটি, কে এম খালেদের নামে ২১ কোটি, মোল্লা এন্টারপ্রাইজের নামে ২০ কোটি, আজাদ অটোমোবাইলসের নামে ৯ কোটি এবং কামাল উদ্দিনের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিকর বিনিয়োগের মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের আরও ২৮৭ কোটি টাকার তহবিল আত্মসাৎ করে কোম্পানিটির সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। এর মধ্যে বাংলা লায়ন কনভার্টেবল জিরো কুপন বন্ডে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪০ কোটি, পিএফআই সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৩২ কোটি, প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগের মাধ্যমে ১৪ কোটি, আল-ফারুক ব্যাগস-এ বিনিয়োগের মাধ্যমে ২ কোটি এবং কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব দেখিয়ে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এ ছাড়া ৪৩২ কোটি টাকার পরিচালনাগত ত্রুটি ও অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। আর এই সবই কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও এমএ খালেক করেছেন কোম্পানিটির সাবেক সিইও মো. হেমায়েত উল্লাহসহ কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশের মাধ্যমে। আর এই টাকা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মিয়ামি মেট্রোপলিটন এলাকার পাম বিচ কাউন্টির বৃহত্তম পৌরসভা ওয়েলিংটন গ্রামের মানাতি বে এলএন রোডের লেকপাড়ে  বিলাসবহুল বাড়ি (১১৫২২) কিনেছেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম। কোনো ঋণ ছাড়াই পুরো টাকা দিয়ে ২০১৪ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ ডলার দিয়ে বাড়িটি কেনা হয়েছিল। এ ছাড়াও তার ছেলেমেয়ের নামে নজরুল ইসলাম সেখানে ৩টি কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। 

কে এই নজরুল: মুন্সীগঞ্জ সদরের মিরকাদিম এলাকার পানাম গ্রামের অতিদরিদ্র ঘরের সন্তান হলেও বর্তমানে মো. নজরুল ইসলামের বর্তমান ঠিকানা হয়েছে গুলশানের ৬২ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাড়ি প্রাইমা ভেরা অ্যাপার্টমেন্টের ৫ তলার ৫-এ তে। ১৯৮৮ সালে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে জাপানে চলে যান। সেখানে যাওয়ার পর অর্থ আত্মসাৎ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় তাকে ওই দেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে ফেরত এসে শুরু করেন হুন্ডি ব্যবসা। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ ব্যবসার মাধ্যমে কামিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ টাকা। এ সময় জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী রাজনীতিতে। একপর্যায়ে তার নজর পড়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানি ফারইস্টের দিকে। ২০০০ সালের মে মাসে ২৫ লাখ টাকায় শেয়ার কিনে হয়ে যান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের উদ্যোক্তা শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অন্যান্য পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দখল করে নেন ফারইস্টের চেয়ারম্যানের পদ। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। 

কোম্পানিটির বর্তমান বোর্ডের এক পরিচালক বলেন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। প্রতিষ্ঠার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক এবং বিভিন্ন সময় ভাইস চেয়ারম্যান ও ইসি চেয়ারম্যান  হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. ফখরুল ইসলাম। ওই সময়ের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী কোম্পানিতে তেমন কোনো আর্থিক অনিয়মের কথা শোনা না গেলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নেয় মো. নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকরা। এরপর থেকেই হাজার হাজার কোটি টাকা (এমটিডিআর) আত্মসাৎ করে চরম বিপদে ফেলেছে কোম্পানির প্রায় ৩৯ লাখ গ্রাহককে। ৪ হাজার ৩শ’ ডেস্ক কর্মকর্তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রায় ৩০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে এই নজরুল ইসলাম ও খালেক। ফেইক অ্যাকাউন্ট করে কোম্পানির হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা। পার্চেজ কমিটির নামে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয় কোম্পানির আইটি বিভাগ, জেনারেল সার্ভিস ও অডিট বিভাগ। তাদের আর্থিক অনিয়ম ধামাচাপা দিতে চক্রটি কোম্পানির সফটওয়্যার থেকে সকল ভাউচার ডিলিট করে দেয়া হয়। তাদের এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে ফারইস্টের উদ্যোক্তা পরিচালক ও বর্তমান চেয়ারম্যান মো. ফখরুল ইসলাম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট পিটিশন করেন। আদালত ওই রিট পিটিশনের (নম্বর-৮৯৩২/২০) শুনানি শেষে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) তদন্তের নির্দেশ দেন। বিএসইসি’র তদন্তে জানা যায় নজরুল-খালেকের দুর্নীতির মাধ্যমে ফারইস্টের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক পরিচালক এম এ খালেক। তার বিরুদ্ধে দুদকে তিনটি, ঢাকা আদালতে ২টি সহ শাহবাগ থানায়ও তাদের বিরুদ্ধে কোম্পানির পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয়া বর্তমান বোর্ডের নেতৃত্বে প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নজরুল-খালেকের দুর্নীতির ধকল কাটিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশে বীমা খাতের অন্যতম এ প্রতিষ্ঠানটি। ইতিমধ্যেই নতুন বোর্ডের অধীন গত ৫ মাসে হাজার হাজার পলিসি হোল্ডারকে তাদের বীমা দাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ই জানুয়ারি একদিনেই ৯ হাজার ৫৯২টি বীমা দাবি পরিশোধের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ধারাবাহিকভাবে ম্যাচুরিটি পাওয়া সকল বীমা দাবি পরিশোধ করা হবে। ইতিমধ্যে এ প্রক্রিয়াটি শুরু করা হয়েছে। কোম্পানিতে নতুন পলিসির সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানান তিনি। 

কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও পরিচালক এম এ খালেকের দুর্নীতির বিষয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান ও ফারইস্ট কোম্পানি তৈরির প্রথম উদ্যোক্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নজরুল-খালেক ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। তাদের হাতে আত্মসাৎ হওয়া টাকা উদ্ধারে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে শত প্রতিকূলতার মাঝেও গ্রাহকদের বীমা দাবি পরিশোধ কার্যক্রম থেমে নেই। সেটিও চলমান রয়েছে। এ কোম্পানির প্রতি গ্রাহকদের এখনো আস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।

তবে গ্রাহকের জমাকৃত টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহবাগ থানার মামলায় গত ১৭ই অক্টোবর থেকে কারাগারে থাকায় এসব বিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ৫ই আগস্ট থেকে আত্মগোপনে থাকায় ফারইস্টের সাবেক পরিচালক এম এ খালেকেরও কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button