Bangladesh

যেভাবে লাল-সবুজের পতাকা আমাদের হলো

রক্তিম লাল আর গাঢ় সবুজ আমাদের গর্ব আর আনন্দের প্রতীক। সবুজের পটভূমিতে উজ্জ্বল লালের বৃত্ত কেবল কোনো আয়তক্ষেত্র নয়, আমাদের হৃদয়ের একেবারে গভীরে প্রোথিত এর অর্থ। যে লালে মিশে আছে শহীদের রক্ত আর সবুজে এ দেশের মানুষের জীবনীশক্তি। প্রতিটি জাতীয় উৎসবে বাংলাদেশের পরিচয় ফুটে ওঠে তাই এই লাল-সবুজে।

একটা পতাকা ঐক্য আর দেশপ্রেমের প্রতীক, শোষণ, অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের শক্তি।

তবে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা আজকের চেয়ে কিছুটা আলাদা ছিল। সবুজের বুকে লাল বৃত্তে ছিল সোনালি রঙে বাংলার মানচিত্র।

এই পতাকার ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধেরও অনেক আগের। ১৯৬৬ সালে সোনালি সবুজের এই পতাকার যারা নকশা করেছিলেন তাদের মনে ছিল মুক্ত বাংলাদেশের ধারণা।

যেভাবে পতাকার নকশা এসেছিল

আইয়ুব খানের শাসনামলে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, সাবেক ও চাকরিরত কয়েকজন সেনাসদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এবং মামলার দুই নম্বর আসামি মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৬৬ সালের জুনে তার চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির বাসভবনে একটি সভা ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি উপস্থিতদের একটি ডায়েরি দেখান, যাতে প্রস্তাবিত স্বাধীন দেশ ‘বাংলাদেশ’ গঠনের কিছু দিক-নির্দেশনা ছিল।

অভিযোগপত্রে আরও দাবি করা হয়, ওই বৈঠকে সবুজ ও সোনালি রঙের একটি পতাকাও দেখানো হয়েছিল। (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা: প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র/ শাহিদা বেগম)

এটিই ছিল পতাকার প্রথম ধারণা ও প্রাথমিক খসড়া।

দ্বিতীয় খসড়াটি তৈরি করেছিল ছাত্ররা, ১৯৭০ সালে। এক রাতের মধ্যেই কাজটি করা হয়েছিল।

১৯৬২ সালে গঠিত স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস নামে একটি গোপন সংগঠন এই আইডিয়া দিয়েছিল। সংগঠনটি স্বাধীনতা সংগ্রামকে চূড়ান্ত পর্বে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৭০ সালের ৭ জুন পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক জোট (জাতীয় শ্রমিক ঐক্য)। ছাত্রলীগ পরবর্তীতে একটি বিশেষ বাহিনী (জয় বাংলা বাহিনী) গঠন করে মুজিবকে গার্ড অব অনার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। (বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র: কাজী আরেফ আহমেদ)

স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস সিদ্ধান্ত নেয় কুচকাওয়াজে শেখ মুজিবকে একটি ‘ব্যাটালিয়ন ফ্ল্যাগ’ উপহার দেওয়া হবে। সেই পতাকা তৈরির মূল দায়িত্ব তখন দেওয়া হয় কাজী আরেফ আহমেদকে। (স্বাধীনতা সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ/ সিরাজুল আলম খান)

প্যারেডের একদিন আগে ৬ জুন সন্ধ্যায় কাজী আরেফ ছাত্রনেতা মনিরুল ইসলাম, শাহজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে নিউক্লিয়াসের পতাকা তৈরির সিদ্ধান্তের কথা জানান। তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর কক্ষে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

আরেফ আরও বলেন, এই ব্যাটালিয়নের পতাকাই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।

মনিরুল এবং রব পতাকার গাঢ় সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডের পরামর্শ দেন, আর সিরাজ লাল রংয়ের প্রস্তাব দেন।

আরেফ তখন গাঢ় সবুজের মাঝখানে লাল সূর্যের একটি পতাকা এঁকে সবাইকে দেখাযন। নিউক্লিয়াসের হাইকমান্ড সিরাজুল আলম খান নকশাটি অনুমোদন করেন।

এদিকে পাকিস্তান সরকার ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’ তৈরির ষড়যন্ত্র চলছে বলে প্রচারণা চালাচ্ছিল। তাই, আরেফ তখন লাল সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের একটি সোনালি মানচিত্র যুক্ত করার প্রস্তাব দেন।

তার যুক্তি হিসাবে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের যৌক্তিক আন্দোলন ভারত বা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী এবং এজেন্টরা জড়িত বা সমর্থন দেয় বলে পাকিস্তান প্রায়ই অপপ্রচার চালায়।

পাকিস্তান প্রশাসন ‘ইউনাইটেড স্টেটস অব বেঙ্গল’ এর একটি কাল্পনিক মানচিত্র বিতরণ করত, যেখানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাসহ পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং মিয়ানমারের আরাকান ছিল। বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ক্ষুণ্ণ করার জন্য এটি করা হয়েছিল।

এই ধরনের অপপ্রচার থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের মানচিত্রের লাল বৃত্তে পাট ও পাকা ধানের প্রতীক হিসেবে সোনালি রংকে বেছে নেওয়া হয়।

সিদ্ধান্ত হওয়ার পর কামরুল আলম খান খসরুকে কাপড় কিনতে পাঠানো হয়। তিনি নিউমার্কেটের অ্যাপোলো শপ থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল কাপড় নিয়ে আসেন।

এরপর বলাকা ভবনের তৃতীয় তলায় পাক ফ্যাশনে পতাকা সেলাই করতে দেন তিনি। পাকিস্তানি দর্জি আব্দুল খালেক বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করেছিলেন।

সবুজ-লাল পতাকা সেলাই হয়ে গেলে তার ওপর সোনার বাংলার মানচিত্র আঁকার চ্যালেঞ্জ ছিল। এ জন্য ইকবাল হলে ডাকা হয় গোপন ছাত্র সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্য শিব নারায়ণ দাসকে।

তবে, শিব নারায়ণ বলেছিলেন যে তিনি কেবল মানচিত্রটি রঙ করতে পারেন, আঁকতে পারেন না। হাসানুল হক ইনু এবং ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ তখন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বর্তমানে বুয়েট) ছাত্র এনামুল হকের কাছে যান, যিনি ট্রেসিং পেপারে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকে দেন।

শিব নারায়ণ দাশ ম্যাচের কাঠি দিয়ে মানচিত্রের চারপাশ এঁকে নেন এবং সোনালি রঙে রং করেন।

এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা সম্পূর্ণ হয়।

ওই রাতেই ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর কক্ষে এক সভায় এটি অনুমোদন করা হয় এবং পরদিন সকালে শেখ মুজিব ‘জয় বাংলা বাহিনী’কে ‘ব্যাটালিয়ন পতাকা’ উপহার দেন। কমান্ডার আ স ম আবদুর রব তা গ্রহণ করেন।

পতাকা তৈরির প্রক্রিয়ায় ২২ জন ছাত্রনেতা জড়িত ছিলেন, যারা গোপনীয়তার সঙ্গে পুরো কাজটি করেছিলেন।

প্রথম পতাকা উত্তোলন

১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা ১৯৭১ সালের ২ মার্চ প্রথমবারের মতো পতাকা উত্তোলন করেন।

এতে প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল, যাদের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন পরিচালনা করা এবং আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটানো।

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ স্থগিত করার প্রতিবাদে পরিষদের ডাকা সমাবেশে ছাত্রদের পক্ষে পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসু ভিপি আ স ম রব।

সমাবেশটি বটতলায় অনুষ্ঠিত হলেও চারুকলা ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের ছাদে পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল যাতে সবার চোখে পড়ে।

সেদিনের স্মৃতিচারণ করে আ স ম রব দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তিনি কেবল ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালন করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে কোনো দেশের নির্দিষ্ট পতাকা ও সংগীত ছিল না। বাংলাদেশ একটি বিরল উদাহরণ যেখানে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই একটি পতাকা ও একটি সংগীত চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।’

পতাকা উত্তোলন স্বাধীনতাকামী শিক্ষার্থী ও জনগণকে অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তাদের মধ্যে মুক্তির ক্ষুধা জাগিয়ে তুলেছিল, যোগ করেন তিনি।

তিন বলেন, ‘আমাদের কাছে তখন সশস্ত্র বিপ্লবের কোনো বিকল্প ছিল না এবং পতাকা উত্তোলন বাঙালির দেশপ্রেমিক চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে।’

পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে (২৩ মার্চ) জয় বাংলা বাহিনী পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে তার পরিবর্তে লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করে।

পতাকাটি পরে শেখ মুজিবের ধানমন্ডি-৩২ এর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তিনি তা উত্তোলন করেন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে জাতীয় সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম ১০ লাইন এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটিকে রণসংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

সেখানেই পতাকা থেকে মানচিত্র সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পরে পটুয়া কামরুল হাসান জাতীয় পতাকাকে বর্তমান রূপ দেন।

সবুজের বুকে লাল বৃত্তের এই পতাকাটি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকায় পরিণত হয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button