Bangladesh

যে কারণে নতুন মজুরি প্রত্যাখ্যান করছেন শ্রমিকরা

বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে সরকারি ঘোষণা আসলেও তা প্রত্যাখ্যান করে বুধবার গাজীপুরে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে একজন নারী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন আরো বেশ কয়েক জন শ্রমিক।

নিহত শ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুনের পরিবারের সদস্যরা তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।

আঞ্জুয়ারা খাতুনের ফুপু রাশেদা জানান, বুধবার সকালে আঞ্জুয়ারা খাতুন অফিসে গেলে সেটি বন্ধ বলে জানতে পারেন। পরে সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে মাথায় গুলি লাগে। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়।

‘অফিস ছুটি অইছে বাসায় আইসা পড়তে গেছে রাস্তা দিয়া, হ্যারা গুলি করছে।’

কোনাবাড়ি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম আশরাফ উদ্দিন বলেন, কোনো নারী শ্রমিকের মৃত্যুর খবর তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। কারণ ওই এলাকার হাসপাতালে কেউ ভর্তি হননি।

তবে সকালে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ, কারখানায় ভাঙচুর, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সকাল ৮টার দিকে এটা শুরু হয়, জরুন এলাকার কয়েকটা গার্মেন্টসে হয়েছে।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, কোনাবাড়ি এলাকায় একটি গার্মেন্টস শ্রমিকরা সংঘবদ্ধভাবে রাস্তায় অবস্থানের চেষ্টা করে। পুলিশ শ্রমিকদের প্রথমে বুঝিয়ে তাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করে। কিছু শ্রমিক পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ে। পরে পুলিশও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।

স্থানীয় একটি গণমাধ্যমের সাংবাদিক মুখলেসুর রহমান জানান, যে সব শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেছে তাদের সাথে কথা বলেছেন তিনি।

তারা হমানকে জানিয়েছেন, যে নারী মারা গেছে তার মাথায় টিয়ারশেল লাগার কারণে সে মারাত্মকভাবে আহত হয়।

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকা,চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েক দিন ধরেই বিক্ষোভ করে আসছে পোশাক শ্রমিকরা।

বুধবারও গাজীপুরে অনেক কারখানা বন্ধ ছিল। আর যেগুলো খোলা ছিল সেগুলোও দুপুরের খাবারের বিরতির পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো: আশরাফুজ্জামান বলেন, মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে যে ক্ষোভ আছে সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই দুর্বৃত্তরা বুধবার গাজীপুরে বিক্ষোভ ও ভাংচুরের মতো কাজে শ্রমিকদের উস্কানি দিয়েছে।

আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন ছিল শ্রমিকের। সেটা শান্তিপূর্ণ ও অহিংস একটা আন্দোলন ছিল। পাশাপাশি যে রাজনৈতিক অস্থিরতা সব মিলিয়ে এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে।’

‘শ্রমিকদের প্রত্যাশা আদৌ মেটেনি’
৭ নভেম্বর বিকেলে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা করার ঘোষণা দেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। পোশাক শ্রমিকদের প্রতিনিধি এবং মালিকপক্ষের প্রতিনিধিদের সাথে সরকারের আলোচনার পর এই ঘোষণা দেয়া হয়।

মজুরি বৃদ্ধির এই ঘোষণাকে শ্রমিকদের একটা পক্ষ মেনে নিলেও আরেকটি পক্ষ তা মেনে নেয়নি। বরং বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে তারা।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো: আশরাফুজ্জামান বলেন, শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরির যে ঘোষণা এসেছে তাতে শ্রমিকরা সন্তুষ্ট নয়। তাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।

ক্ষোভের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে শ্রমিকদের জন্য যে সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়।

‘বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে এই মজুরি নির্ধারিত হয়নি। ১২ হাজার ৫০০ টাকায় একজন শ্রমিকের পরিবার চলাটা অসম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় যে শ্রমিক ১৮ থেকে ২০ টাকা আলুর কেজি খাইছে, সেই শ্রমিক এখন ৭০ টাকা আলুর কেজি খাচ্ছে।’

শ্রমিক নেতারা অকেকেই বলছেন, শ্রমিকদের জন্য যে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি তারা মানেন না। নির্ধারিত সময়ে এই দাবির বিরুদ্ধে তারা আপত্তি তুলে ধরবেন।

১৮টি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, তাদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জন্য ২৩ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণের যে দাবি ছিল সেটি নিয়ে সমঝোতা আলোচনার সুযোগ রেখেই এই দাবি তুলেছিলেন তারা।

তারা মনে করেছিলেন যে, অন্তত সন্তোষজনক একটা বেতন শ্রমিকদের জন্য নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু গতকালের মজুরি ঘোষণা তাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি বলে জানান তিনি।

সর্বনিম্ন মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি আরো যে সব দাবি ছিল তা হচ্ছে, বেতনের ৬৫ শতাংশ মূল বেতন ধরা, সাতটির বদলে পাঁচটি গ্রেড করা এবং বছরে ১০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি। একইসাথে পোশাক শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করারও দাবি ছিল তাদের।

মঙ্গলবারের ঘোষণায়, মোট মজুরির ৬৩ শতাংশ মূল বেতন, বার্ষিক ৫ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাঁচটি গ্রেড করা হয়েছে। একইসাথে পোশাক শ্রমিকদের পরিবারের একটি করে টিসিবি কার্ড দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।

আমিরুল হক আমিন বলেন, এসব জায়গায় তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

তিনি বলেন, রাস্তায় টিসিবির ট্রাক থেকে যখন চাল-ডাল কিনতে হবে তখন পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় কাজে ব্যস্ত থাকবে। তাই এই কার্ড তাদের কোনো কাজে আসবে বলে মনে করেন না তিনি।

এর পরিবর্তে শুধু শ্রমিকদের জন্যই যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহের আলাদা ব্যবস্থা বা রেশনিং ব্যবস্থা করা যায়, তার দাবি করছেন তারা। পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সবার না হলেও নিচের দিকের গ্রেডগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য যাতে এই ব্যবস্থা করা যায় সেই সুযোগও রাখতে চান তারা।

আইন অনুযায়ী, মজুরি বোর্ডের মজুরি নির্ধারণের ঘোষণার পর ১৪ দিনের মধ্যে সেটি প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করতে হয়। এরপরের ১৫ দিনের মধ্যে মজুরি নিয়ে আপত্তি তোলার সুযোগ রয়েছে।

হক জানিয়েছেন, এই সময়ের মধ্যে আপত্তি তোলার পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা। একইসাথে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ এবং তাদের জন্য আলাদা রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি লেখার সিদ্ধান্তও তাদের রয়েছে বলে জানান তিনি।

‘মন্দের ভাল’ সিদ্ধান্ত?
চলতি বছরের এপ্রিলে মজুরি বোর্ড গঠনের পর পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে মজুরি নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি নির্ধারণ করতে নভেম্বর পর্যন্ত সময় লেগেছে এবার। এই সময়ের মধ্যে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের প্রতিনিধি ও সরকারের মধ্যে অন্তত ছয়টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এই মজুরি বোর্ডে শ্রমিকদের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি।

শ্রমিকদের অসন্তোষের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত কেউ মানবে, কেউ মানবে না সেটাই স্বাভাবিক। যেহেতু এটা রফতানিমুখী শিল্প তাই সব কারখানা যাতে এই মজুরি দিয়ে চলতে পারে, বন্ধ হয়ে না যায় সে বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে।’

কারণ কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে তখন আবার শ্রমিক বেকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে তিনি যুক্তি দিচ্ছেন।

তিনি আরো বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত এটি খসড়া সিদ্ধান্ত। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। ১৪ দিনের মধ্যে একটা বৈঠক হবে। সেখানে এই সিদ্ধান্ত সংশোধন-পরিমার্জন করার সুযোগ আছে।’

তবে যে মজুরিটি নির্ধারিত হয়েছে সেটি হচ্ছে সর্বনিম্ন মজুরি, সর্বোচ্চ নয়। এর বাইরে শ্রমিকদের চাওয়া অনুযায়ী, সাত থেকে নামিয়ে পাঁচটি গ্রেড করা হয়েছে। রেশনিং ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত পারিবারিক কার্ডের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মালিকপক্ষের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আদায় করা যায়নি উল্লেখ করে ইসলাম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নাকি ওনারা বলেছে যে সাড়ে ১২ পর্যন্ত ওনারা উঠতে পারবে। এর বাইরে তারা পারবে না।’

এই সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, সর্বনিম্ন যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি পাবেন কারখানায় যারা হেলপার বা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তারা। এই সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি নয়। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগ এর চেয়ে বেশি মজুরি পাবেন। কারণ অনেক কারখানা অটোমেশন হয়ে যাওয়ার কারণে সহযোগীর পদ কমে এসেছে। শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজারদর বিবেচনায় নেয়ার পাশাপাশি শিল্পের সক্ষমতার কথা আইনে বলা হয়েছে।

তাই বৈশ্বিক মন্দাসহ সব কিছু বিবেচনায় কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ না হলেও ‘মন্দের ভাল’ হিসেবে এটি মেনে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, তারপরও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।’

এছাড়া শ্রমিকদের প্রতি বছর ৫ শতাংশ বেতন বাড়ার সুযোগ রয়েছে, রেশনিং ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ারও একটা সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি হলে শ্রমিকদের সংসার চালাতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না বলে তিনি আশা করছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d