International

যে কারণে শিখদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের আন্দোলন ভারতে

ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিচ্ছে দেশ দুটি। এ উত্তেজনার সূত্রপাত কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে হত্যার মধ্য দিয়ে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারত জড়িত বলে অভিযোগ করেছে কানাডা। তবে এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।

হরদীপ সিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শিখদের ‘খালিস্তান আন্দোলন’। তিনি এই আন্দোলনের পক্ষে প্রচার–প্রচারণা চালাতেন। বেশ কয়েক দশকের এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, শিখদের জন্য ভারতের পাঞ্জাবে ‘খালিস্তান’ নামের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রশ্ন জাগতে পারে, ভারতে কেন আলাদা রাষ্ট্র চাইছেন শিখরা?

শিখ কারা, কোথায় তাদের বসবাস
বিশ্বের বেশ বড়সংখ্যক মানুষ শিখ ধর্ম পালন করেন। সারা বিশ্বে প্রায় আড়াই কোটি শিখ রয়েছেন। অনুসারীদের দিক দিয়ে এটি পঞ্চম বৃহৎ। শিখধর্মের গোড়াপত্তন পাঞ্জাবে, ষোড়শ শতকে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়পাঞ্জাব।

শিখদের বেশির ভাগই ভারতে বসবাস করেন। দেশটির ১৪০ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশই তাঁরা। ভারতের বাইরেও শিখদের বড় একটি অংশের বসবাস রয়েছে।

ভারতের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখধর্মাবলম্বীর বসবাস কানাডায়, কমবেশি ৭ লাখ ৮০ হাজার। এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের বেশি। কানাডা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রায় পাঁচ লাখ শিখ বাস করেন। আর অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন প্রায় দুই লাখ শিখ।

শিখদের একাংশ কেন আলাদা রাষ্ট্র চায়
খালিস্তান আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, ভারতে শিখদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। গত শতকের আশির দশকে দেশটির পাঞ্জাব রাজ্যে এই আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। সে সময় রাজ্যটিতে এ আন্দোলনের জেরে ব্যাপক সংঘাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটে।

এ আন্দোলন থামাতে মাঠে নামে ভারতের সামরিক বাহিনী। বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে আন্দোলনের গতি থমকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধ্যাপক শ্রুতি কাপিলা বলেন, আধুনিক পাঞ্জাবের রাজনীতি খালিস্তান আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছে। আর স্বাধীন রাষ্ট্র বর্তমানে বেশির ভাগ শিখের চাওয়া–পাওয়া নয় বলেও রাজনীতিবিদেরা দাবি করছেন।

খালিস্তান নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা উত্তেজনা আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত দুটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

তবে আন্দোলন নিয়ে এখনো বিদেশে অবস্থানকারী শিখদের অবস্থান ভিন্ন। তাঁরা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার–প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে তাঁদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি জোরদার হয়েছে।

পাঞ্জাবে শিখদের পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দির

পাঞ্জাবে শিখদের পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দির

খালিস্তান কেন ভারতের জন্য এতটা স্পর্শকাতর
বরাবরই খালিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছে ভারত। ভারতের মূল ধারার সব রাজনৈতিক দল, এমনকি পাঞ্জাবের দলগুলোও বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে আসছে।

খালিস্তান নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা উত্তেজনা আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত দুটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একটি পাঞ্জাবে শিখদের পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দিরে চালানো অভিযান এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড।

১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালায় ভারতের সামরিক বাহিনী। অভিযানে ওই মন্দিরে অবস্থানকারী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উৎখাত করা হয়। এ সময় নিহত হন অনেকে। মন্দিরেরও উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়।

অভিযানের কয়েক মাস পরে দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। এর জেরে চার দিন ধরে চলে দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত। মারা যান হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন শিখ। ধারণা করা হয়, দাঙ্গা–সংঘাতে নিহতের সংখ্যাটা ছিল ৩ থেকে ১৭ হাজার পর্যন্ত।

খালিস্তান ইস্যু ভারতের জন্য এখনো স্পর্শকাতর। কারণ, আশির দশকের সেই ক্ষত এখনো তাজা। শিখদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের অবস্থান একই ছাতার নিচে। তাই দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের স্বার্থে কোনো সরকারেরই খালিস্তান ইস্যুতে ছাড় দেওয়ার উপায় নেই।

শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর

শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর

কে এই হরদীপ সিং
হরদীপ সিংয়ের জন্ম পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলার ভার সিং পুরা গ্রামে। ১৯৯৭ সালে তিনি কানাডায় পাড়ি জমান। পরে দেশটির নাগরিকত্ব পান তিনি। গত ১৮ জুন দেশটিতে একটি শিখ মন্দিরের বাইরে হরদীপকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৫ বছর।

কানাডায় যাওয়ার পর মিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করেন হরদীপ সিং। পরে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে শিখ নেতা হিসেবে জনপ্রিয়তা পান তিনি। ২০২০ সালে তাঁকে সন্ত্রাসী তালিকায় ফেলে ভারত সরকার। ভারতের অভিযোগ, খালিস্তানের পক্ষে প্রচার–প্রচারণা চালানো ‘খালিস্তান টাইগার ফোর্স’ নামের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল হরদীপের।

স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে মত প্রকাশে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী শিখদের কোনো বাধা দেবে না সে দেশের সরকার।

তবে ভারত সরকারের এ অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন হরদীপ সিংয়ের সমর্থকেরা। তাঁদের ভাষ্য, ভারতে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সক্রিয় থাকার কারণে আগেও তাঁকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। হরদীপকে নিয়ে বিগত কয়েক মাসে তিনজন খ্যাতনামা শিখ নেতার মৃত্যু হলো।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

প্রবাসী শিখদের ওপর যেভাবে চাপ দিচ্ছে ভারত
চলমান কূটনৈতিক উত্তেজনার পেছনে রয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য সরকারের ওপর ভারত সরকারের ক্রমবর্ধমান চাপ। তিন দেশেই বহু শিখের বসবাস রয়েছে। ভারত সরকার খোলাখুলিভাবে বলেছে, এই তিন দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘শিখ চরমপন্থা’ দমাতে তাদের ব্যর্থতা।

অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খালিস্তানপন্থীদের হাতে হিন্দু মন্দির ভাঙচুরের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন তাঁরা। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে মত প্রকাশে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী শিখদের কোনো বাধা দেওয়া হবে না।

প্রবাসী শিখদের নিয়ে নয়াদিল্লির সবচেয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে কানাডা। দেশটি খালিস্তানপন্থীদের সক্রিয়তা রুখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে ভারত সরকার। যদিও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, চলমান সংঘাতে লাগাম টানবেন তিনি। তবে কানাডায় বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছেন তিনি।

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের বাইরে গত মার্চে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বিক্ষোভে খালিস্তান লেখা হলুদ ব্যানার দেখা গিয়েছিল। এ ছাড়া হাইকমিশন ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে ভারতের জাতীয় পতাকা সরিয়ে দিয়েছিলেন এক ব্যক্তি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button