International

যে নতুন কৌশলে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যেতে চায় চীন

বিশ্বখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকা অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাপকাঠিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ আমেরিকা। এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এশিয়ার দেশ চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে নতুন কৌশল অবলম্বন করছে চীন। আর এই কৌশলের মূল মন্ত্র হচ্ছে ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তির’ বিকাশ।

এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।  প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গত বছর দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হেইলংজিয়াং প্রদেশ সফরে যান। এটি চীনের রাস্টবেল্ট অঞ্চলের একটি এলাকা, যেখানকার কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চীনের অর্থনীতিতে এখন কী ধরনের সমস্যা জেঁকে বসেছে, এই অঞ্চলটি তার একটি উদাহরণ।

চীনের মধ্যে সবচেয়ে কম জন্মহার এই হেইলংজিয়াং অঞ্চলের। এর প্রভাব হিসেবে ওই অঞ্চলের বড় বড় শহরে কমছে বাড়ির দাম। ২০২৩ সালে এই প্রদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয়ের পর দেখা যায়, এই অঞ্চলের জিডিপি প্রবৃদ্ধি একেবারে হয়নি বললেই চলে; উল্টো গভীর মূল্যহ্রাসের কবলে পড়েছে অঞ্চলটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তারপরও ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ শি জিন পিংয়ের পরিকল্পনা আছে। গত বছর সেই সফরে গিয়ে শি জিন পিং প্রাদেশিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তির’ বিকাশ ঘটান। এরপর এই শব্দবন্ধ বেশ কয়েকবার সংবাদপত্র ও সরকারি অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হয়েছে। গত মাসে দেশটির রাবার স্ট্যাম্প সংসদে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াং জিয়াংকিং এই শব্দবন্ধকে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তি’ শীর্ষক স্লোগানকে- ১৯৭৮ সালে যে নব চীনের সূচনা হয়, সেই সময় যে নীতির ভিত্তিতে তা হয়েছিল, তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সংস্কার ও বাজার উন্মুক্ত করার স্লোগান চীনের জাতীয় জীবনে এখনও জ্বলজ্বলে। নতুন এই স্লোগানও দীর্ঘদিন থেকে যাবে বলে ধারণা।

এই শব্দের অর্থ কী? চীনের সরকারি কর্মকর্তারা অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বহু বছর ধরে চীনের উৎপাদক শক্তি ছিল মূলত শ্রমিক ও পুঁজি সংগ্রহনির্ভর। ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে চীনের শ্রমশক্তি আকার বেড়েছে ১০ কোটি; অর্থাৎ এই সময়ে আরও ১০ কোটি মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে। 

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এশিয়া প্রোডাকটিভিটি অর্গানাইজেশনের তথ্যানুসারে, ২০০১ সালের পরবর্তী দুই দশকে; অর্থাৎ ২০ বছরে চীনের পুঁজির পরিমাণ জিডিপির ২৫৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর এই পুঁজি সংগ্রহ হয়েছে মূলত নতুন নতুন সম্পদ ও অবকাঠামো খাতে।


চীনের কর্মশক্তি যেমন কমছে, তেমনি সেদেশে সম্পত্তির চাহিদাও কমছে। আগে যত মানুষ গ্রাম থেকে শহরে যেতেন, এখন তত মানুষ যাচ্ছে না। আবাসন খাত থেকে যে ফাটকাবাজি করে মুনাফা করা যাবে, তার নিশ্চয়তা এখন আর নেই এবং সম্ভাব্য বাড়ি ক্রেতারাও এখন আগেভাগে ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী নন। কারণ, তাদের মনে ভয়, বিপর্যস্ত আবাসন কোম্পানিগুলো ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করার আগে নিঃস্ব হয়ে যায় কি না।

আবাসন খাতের সংকট সৃষ্টি হওয়ার পর ক্রেতাদের আত্মবিশ্বাস যেমন কমেছে, তেমনি জমি বিক্রি করে স্থানীয় সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। কোভিডজনিত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও চীনের অর্থনীতিতে গতি আসছে না। পুনরুদ্ধার যা হচ্ছে, তা সব খাতে সমানভাবে হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় এত বেশি নয় যে, সব কর্মক্ষম মানুষের কাজ সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণে টানা তিন ত্রৈমাসিকে চীনের মূল্যহ্রাস হচ্ছে, যেখানে অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে।

চীন এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে আছে, এসব ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ সাধারণত সেবা খাতমুখী হয়; অর্থাৎ উৎপাদন খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে সেবা খাত নির্ভর হয়। কিন্তু চীন সরকারের হৃদয় যেন অন্য কোনও খানে লুকিয়ে আছে। মহামারীর কারণে চীনের উৎপাদিত পণ্য, যেমন সার্জিক্যাল মাস্ক থেকে শুরু করে এক্সারসাইজ বাইকের চাহিদা বেড়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দেশের ভেতরেও লিথোগ্রাফি মেশিন থেকে শুরু করে প্লেনে ব্যবহারের উপযোগী স্টেইনলেস স্টিল উৎপাদনের চাহিদা নতুন করে বেড়েছে।

দেশটির ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে উৎপাদন খাতের হিস্যা ধরে রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে; ২০০৬ সালে যা ছিল জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ, ২০২০ সালে যা এক-চতুর্থাংশের কিছুটা ওপরে।

চীন অনেক দিন ধরেই উৎপাদন খাতে পরিশীলন আনার চেষ্টা করছে, সেজন্য তারা যথাযথ নীতি প্রণয়নেরও চেষ্টা করেছে। সম্প্রতি তারা সেমিকন্ডাক্টর প্রকৌশলে নতুন একাডেমিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিল্পনীতিতে দেশটি যত ব্যয় করে, যেমন ভর্তুকি ও করছাড়, তা আমেরিকাও করে না। নতুন প্রযুক্তির পরিচর্যা ও পুরোনো শিল্প খাতের আধুনিকায়ন করে চীন পরবর্তী শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে চায়; অর্থাৎ সেবা খাত নির্ভর না হয়ে চীন এখনও উৎপাদন খাতের ওপর ভর করে এগোতে চাইছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘নতুন উৎপাদিকা শক্তি’ স্লোগান দিয়ে চীন মার্ক্সবাদী ও নব্য ধ্রুপদি অর্থনীতির তত্ত্বের মিশেল ঘটিয়েছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে চীন উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাইছে—প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে দেশটি।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং মনে করেন, উৎপাদন খাতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নতুন এই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটবে। এই কথার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, প্রযুক্তি খাতে চীনের উচ্চাভিলাষ আগের চেয়ে বেড়েছে এবং অর্থনীতির সঙ্গে তা আরও ভালোভাবে সমন্বিত হচ্ছে। চীনের নেতারা প্রযুক্তি খাতে আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে পুরো জাতিকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার অঙ্গীকার করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই গত মার্চ মাসে চীনের কেন্দ্রীয় সরকার যে বাজেট দিয়েছে, সেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হাতে বরাদ্দ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। অন্য কোনও খাতে বরাদ্দ এতটা বাড়েনি।

শিল্প খাতের আধুনিকায়ন ও নতুন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ—এই দুই মন্ত্রে ভর করে এগোতে চায় চীন; অর্থাৎ আমেরিকাকে হটিয়ে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি হতে চায় এই কৌশলে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d