Bangladesh

রক্ষকই ভক্ষক

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে অস্থিরতা। অনিরাপত্তায় ভুগছেন নারী শিক্ষার্থীরা। ক’দিন পরপরই ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি আলোচিত ঘটনা নতুন করে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তায় দায়িত্বরতদের। কেউ কেউ বলছেন, রক্ষকই এখানে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যে কারণে অবন্তিকার মতো একটি স্বপ্নের মৃত্যু হয়েছে। শুধু  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নয়? এমন নানা ঘটনা ঘটছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও। অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনায় কাঠ গড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের। একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতন।

যৌন হয়রানি। চুরি, ছিনতাই হেন কোনো ঘটনা নেই যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হচ্ছে না। এমন সব ঘটনা ঘটার পর তদন্ত কমিটি হয়। সময়ের ব্যবধানে তা আবার চাপা পড়ে যায়। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতার রাজনীতি চর্চা অতিমাত্রায় পৌঁছে যাওয়ার কারণে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বাড়ছে অপ্রীতিকর ঘটনা। 

যৌন নিপীড়ককে বাঁচাতে গিয়ে পদ হারালেন জাবি প্রক্টর: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান। যৌন নিপীড়নে অভিযুক্ত শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনিকে বাঁচাতে গিয়েই পদ হারালেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রক্টরের সাময়িক দায়িত্ব পেয়েছেন পরিসংখ্যান ও উপাত্তবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলমগীর কবীর। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হাসান স্বাক্ষরিত এক আদেশে বিষয়টি জানানো হয়েছে।

এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনির বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় এক ভুক্তভোগীকে জোরপূর্বক দায়মুক্তিপত্র লেখানোর সময় প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান উপস্থিত ছিলেন। এই দায়মুক্তিপত্র লেখানোর বিষয়টি সামনে আসলে আন্দোলনে নামেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরপরে গত ৩রা ফেব্রুয়ারি জাবিতে ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনায় আন্দোলন আরও তীব্র হয়। ৫ দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন জাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। যার অন্যতম দাবি ছিল প্রক্টরের পদত্যাগ।
পরে আন্দোলনের মুখে গত ২০শে ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় যৌন নিপীড়কের দায়ে মাহমুদুর রহমান জনিকে বরখাস্ত করা হয়। প্রক্টরকে অব্যাহতি না দেয়ায় আন্দোলনকারীরা প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করেন। দুই দফায় এক সপ্তাহ অবরোধ করে রাখেন তারা। ফলে বাধ্য হয়ে প্রক্টর গতকাল পদত্যাগ করেন।

ঢাবিতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে প্রক্টরিয়াল টিমের নানা তৎপরতা চোখে পড়লেও এর বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ। ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় প্রশাসন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের। গত দুই বছরে ক্যাম্পাসে ভিন্নমতালম্বী ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর ২০ বারের বেশি হামলা হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন শতাধিক। এসব হামলার প্রায় প্রতিটিতেই কমবেশি সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ার ভবনের মসজিদে আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের রমজানের ওপর একটি আলোচনা সভায় হামলা চালায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। আয়োজকদের ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে চালানো এ হামলায় পাঁচজন শিক্ষার্থী আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকা না সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের চালানোর ঘটনায় ক্যাম্পাসে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নাম ও পরিচয় ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তবে এ ঘটনায় এখনো কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। 

স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (স্যাট) নাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা এক মানবাধিকার সংগঠন থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০টি ঘটনায় ২৭ শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এরমধ্যে শুধু চারটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। একই বছর ২৬ শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এদের বেশির ভাগই এখনো হলে ফিরতে পারেননি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে এ ধরনের শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ক্যাম্পাসে আর ঘটতো না। 

ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ও পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্ব বর্তায় প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের ওপর। তবে তাদের বিরুদ্ধে গত বছর ভাসমান দোকানসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্পট থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়ার অভিযোগ ওঠে। কেউ চাঁদা না দিলে বন্ধ করে দেয়া হতো দোকান। অবৈধ হলেও চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে পারতো যে কেউ। এসব অপকর্মে জড়িত থাকার অপরাধে প্রক্টরিয়াল টিমের পাঁচ সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভিসি, প্রক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নতুন মুখ আসার পরে কিছুটা বেড়েছে তৎপরতা। বিভিন্ন অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে শাস্তি দেয়া হয়েছে অপরাধীদের। ক্যাম্পাসে মাদকসেবন ও বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধেও আগের চেয়ে নজরাদারি বাড়িয়েছে প্রশাসন। এরপরও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি হামলা, অনিয়ম ও প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গত বছরের এপ্রিলে দায়িত্ব নেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মাকসুদুর রহমান বলেন, আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় তদন্ত চলছে। আমরা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করছি। তদন্তে যারাই দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা সবসময় নিরপেক্ষভাবে আমাদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে চেষ্টা করেছি যেকোনো সমস্যা দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার। অভিযোগে বিচারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পক্ষপাতমূলক আচরণের প্রশ্নই আসে না।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টরের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ: ২০২২ সালের ৩১শে জানুয়ারি নতুন ভিসি হিসেবে যোগদান করেন অধ্যাপক ড এএফএম আবদুল মঈন। তার যোগদানের এক মাস ২৩ দিনের মাথায় ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ পান ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী ওমর সিদ্দিকী। অভিযোগ রয়েছে, জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের ডিঙিয়ে জুনিয়র এক সহকারী অধ্যাপককে প্রক্টর নিয়োগ দিয়েছিল প্রশাসন। ২০২২ সালে ৯ই সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু হল ও নজরুল হলের শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে ৩০-৩৫ জন কর্মী আহত হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাকর্মীরা। 

১লা অক্টোবর ২০২২ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত হলে সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০১৫ সালে গঠিত কমিটির) রেজা এলাহির নেতৃত্বে প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতে মোটরবাইক শোডাউন, ককটেল বিস্ফোরণ, ফাঁকাগুলি ছুড়ে বহিরাগতরা। এ ঘটনায়ও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে প্রক্টরিয়াল টিম। 

২০২৩ সালের ৮ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি বিপ্লব চন্দ্র দাস স্থানীয় যুবদল নেতা ও তার অনুসারীদের নিয়ে ৩ ছাত্রলীগ নেতার ওপর হামলার ঘটনায় প্রক্টরের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইশ’ একর (নতুন ক্যাম্পাসে) ভূমি সম্প্রসারণের সময় বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে প্রক্টরের বিরুদ্ধে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) ১১তম সভায় অনুমোদিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি বাণিজ্যের সঙ্গে তিনি জড়িত। সম্প্রতি প্রকল্পে সীমাহীন ভূমি বাণিজ্যের বিষয়টি জনসম্মুখে আসে। অধিগ্রহণের বিভিন্ন নথি থেকে পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী ভূমি অধিগ্রহণের পূর্বে ৬১১৩ এবং ৬১১৪ নম্বর দাগে নিজের নামে জমি ক্রয় করে রাখেন।

নিজের নামে ছাড়াও অন্য ব্যক্তির নামেও জমি কিনেছেন তিনি। ৬১১৪ নম্বর দাগে জমির দখলদার আবদুর রাজ্জাক, আবদুস সালাম হলেও সেখানে কাজী ওমর সিদ্দিকীর মোবাইল নম্বর দেয়া আছে। আবদুর রাজ্জাক কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ারের গাড়িচালক। অভিযোগ আছে ওমর সিদ্দিকী উপজেলা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠদের একজন। 

এ ছাড়াও অভিযোগ আছে, বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মাদকসেবীরা হাতেনাতে ধরা পড়লেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর না করে নামমাত্র মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেন প্রক্টর। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেও তার সাড়া মেলেনি। 

জবিতে নিষ্ক্রিয় যৌন নিপীড়ন সেল: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) যৌন নিপীড়ন রোধে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ কেন্দ্র’। কিন্তু অভিযোগের সুরাহা না হওয়া, অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হলে বিচারে গড়িমসি করা, পুনরায় নিপীড়িত হওয়ার ভয়সহ নানা কারণে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীরা সেখানে অভিযোগ দিতে চান না। নানা সময়ে ছাত্রীকে অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ তথা অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গি প্রদর্শন, ঘাড় ম্যাসাজ করা, স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ এবং জোরপূর্বক জড়িয়ে ধরা, সম্ভ্রমহানীসহ নিপীড়নের মতো ঘটনা ঘটেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এসব গুরুতর অভিযোগুলোর সত্যতা উল্লেখ করে গত বছরের ১লা আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের প্রভাষক আবু শাহেদ ইমনের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগনামা জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর। 

এমন নানা ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। যার খুব কম সংখ্যক ঘটনাই প্রকাশিত হয়। আর অধিকাংশ ঘটনাই চাপা পড়ে থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে। নিজেদের মানসম্মান ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক শিক্ষার্থীই নানা ধরনের বুলিং ও গুরুতর যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা চেপে রেখে মানসিক অস্বস্তিতে দিন পার করছেন। এসব দেখভালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন সেল থাকলেও ২০১৯ সালের পর থেকে গত চার বছরে দুই থেকে তিনটি অভিযোগপত্র জমা হয়েছে। এসব অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে তদন্ত সাপেক্ষেও নেয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। 

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভাগেরই এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবিএম মানিকের বিরুদ্ধে। ঘটনার প্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন ও তাকে বিভাগের সকল কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। তবে ঘটনার সাত মাস পার হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি কার্যকর হয়নি। 

এদিকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ২০২০ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ৮২তম সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক আব্দুল হালিম প্রামাণিককে শাস্তি দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই শিক্ষক আট বছর কোনো পদোন্নতি পাবেন না এবং পদোন্নতির আবেদন করতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়াও তিনি ১০ বছর কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না এবং নিজ কোর্স ছাড়া পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো কাজ করতে পারবেন না বলেও সিদ্ধান্ত হয় ওই সভায়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ২০১৭ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি নাট্যকলা বিভাগের এক ছাত্রী ক্লাসে উপস্থিতির নম্বরের বিষয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান আব্দুল হালিম প্রামাণিকের কাছে গেলে তিনি ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন ওই ছাত্রী। এ অভিযোগের ভিত্তিতেই তাকে শাস্তি প্রদান করা হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যৌন নিপীড়নের বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী জানান, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেলে অভিযোগ দায়ের করেও কোনো বিচার পাইনি। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে আমার অভিযোগ আমলে নেয়া হয়নি। বরং আমি নানা সময় মানসিক চাপ ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছি।

এ বিষয়ে নাট্যকলা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া সোমা বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নের যতগুলো ঘটনা প্রকাশ্যে আসে তার অনেকগুলোই অপ্রকাশ্য থেকে যায়। আর প্রকাশে যতগুলো আসে সেগুলোরও সুষ্ঠু বিচার হয় না জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেই চলছে। বিচার না হওয়ায় ভুক্তভোগীকে একটা মানসিক ট্রমার মধ্যে দিন পার করতে হয়। একপর্যায়ে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়ে থাকে। 

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন সেল কমিটির আহ্বায়ক এবং প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা বলেন, এটা তো চাইলেই একদিন কিংবা দুইদিনে একটি রিপোর্ট দেয়া সম্ভব হয় না। একটি সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আমাদের নানান পারিপার্শ্বিকতা মোকাবিলা করতে হয়। তারপরও আমরা ইতিমধ্যে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশনের তদন্ত রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছি। আমাদের কাজ শুধু তদন্ত করে রিপোর্ট প্রকাশ করা। কিন্তু আমাদের এখানে তো তেমন অভিযোগই আসে না যৌন নিপীড়নের ঘটনায়।

অভিযোগ কেন আসে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থী জানেই না বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকমের একটি সেল রয়েছে। সেলে অভিযোগ না পড়ার আরেকটি কারণ হতে পারে সেটা হলো ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিত্ব ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা অভিযোগ দিচ্ছে না। 

দীর্ঘদিন ধরেই অস্থির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কয়েক মাস ধরেই অস্থির অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ভাইস চ্যান্সেলরের পদত্যাগের দাবিতে চলছে আন্দোলন। সেইসঙ্গে নিয়মিত ঘটে চলছে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা। গত চার বছরে শাখা ছাত্রলীগের উপ-গ্রুপগুলো অন্তত দেড়শ’ বারেরও বেশি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দুর্বলতায় এসব সংঘর্ষের মূল কারণ বলে মনে করেন শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা। সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে গত বছরের ২৪শে সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে চবি শাখা ছাত্রলীগকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে গত ১১ই ফেব্রুয়ারি চারটি প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেন দুই শিক্ষক। এরমধ্যে রয়েছে দু’টি সহকারী প্রক্টরের পদ, একটি আবাসিক শিক্ষকের পদ, আর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালকের পদ। রেজিস্ট্রার বরাবর সব চিঠিতেই তারা ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করেন বলে উল্লেখ করেন।

এ বছরের ৩১শে জানুয়ারি রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের অভিযোগ করেন একই বিভাগের ছাত্রী। লিখিত অভিযোগে ওই শিক্ষার্থী জানান, ‘থিসিস চলাকালীন সময়ে আমার সুপারভাইজার কর্তৃক যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হই। থিসিস শুরুর পর থেকে তিনি আমার সঙ্গে বিভিন্ন যৌন হয়রানিমূলক; যেমন-জোর করে হাত চেপে ধরা, শরীরের বিভিন্ন অংশে অতর্কিত ও জোরপূর্বক স্পর্শ করা, অসঙ্গত ও অনুপযুক্ত শব্দের ব্যবহার করেছেন। কেমিক্যাল আনাসহ আরও বিভিন্ন বাহানায় তিনি আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে জোরপূর্বক জাপটে ধরতেন।’
এ ঘটনায় বিভাগের শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষককের পদত্যাগের দাবিতে ক্লাস বর্জন করে টানা আন্দোলন করে। পরে প্রশাসন বাধ্য হয়ে ওই শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে। 

ইবিতে নারী শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন: র‌্যাগিং, নির্যাতন ও ভাঙচুরের ঘটনাসহ শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত এক বছরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৫ জন ছাত্রীকে স্থায়ী ও ৮ জন ছাত্রকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া বাকি ৭ জনের মধ্যে ৬ জনকে এক সেমিস্টারের সকল কোর্স ও একজনকে একটা কোর্সের পরীক্ষা বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে এক নবীন ছাত্রীকে র‌্যাগিং ও নির্যাতন ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ ছাত্রীকে গত বছরের ২১শে আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।

এই ঘটনার মাস না পেরুতেই ফের র‌্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। ৩রা অক্টোবর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক নবীন শিক্ষার্থীকে র‌্যাগিংয়ের অভিযোগে একই বিভাগের ৫ জন সিনিয়র শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ভাঙচুরের ঘটনায় গত বছরের ১৫ই জুলাই ৩ ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ। এদিকে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করার অভিযোগে একই বছরের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বিভাগের ৭ জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয় প্রশাসন। 

ক্যাম্পাসের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে গঠিত কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সেলিনা নাসরিন বলেন, সম্প্রতি কোনো অভিযোগ পাওয়ার কথা শুনিনি। কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলেই বসা হয়। কেউ ভিকটিম হলে সে নির্ভয়ে কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবে। এখানে নাম গোপন রেখেও অভিযোগ করার সুযোগ আছে। নিরাপত্তার কারণে কমিটির মিটিংয়ে ভিকটিমের নামও গোপন রাখা হয়।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হাসনাত মাহমুদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ইমরান হোসাইন হিমুু, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জয়নুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সুমন বায়েজিদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি সাইদ হাসান ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি মুতাছিম বিল্লাহ রিয়াদ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button