রণক্ষেত্র ভাঙ্গা

ফরিদপুর-৪ আসনের ভাঙ্গা উপজেলার দু’টি ইউনিয়ন কেটে অন্য আসনে যুক্ত করার প্রতিবাদে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ভাঙ্গা থানা ও উপজেলা পরিষদ, ইউএনও’র বাসভবন ও অফিসার্স ক্লাবে ঢুকে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। সরকারি এসব ভবনের প্রতিটি তলায় চেয়ার, টেবিল, ফ্যানসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা স্থানীয় মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয়। হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরাও। গতকাল সকাল থেকেই ভাঙ্গা মোড়ে মহাসড়ক অবরোধ করে এই তাণ্ডব চালায় আন্দোলনকারীরা। তাদের অবরোধে দিনভর বিচ্ছিন্ন ছিল ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক। বন্ধ ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যান চলাচল। সন্ধ্যার দিকে আন্দোলনকারীরা রাস্তা থেকে সরে গেলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বেশ কিছুদিন ধরে ফরিদপুর-৪ সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে ও পুরনো সীমানা বহালের দাবিতে মহাসড়ক এবং রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আসছিল স্থানীয়রা। চলমান ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার মধ্যরাতে নগরকান্দা উপজেলা থেকে আলগি ইউপি চেয়ারম্যান সিদ্দিকুর রহমানকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর রোববার রাতে ৯১ জনের নামে ও ১৫০ জনের অজ্ঞাত নামে মামলা করে পুলিশ। গতকাল সকালে ফের আন্দোলনে নামে বিক্ষোভকারীরা। দুপুরে তা সহিংস রূপ নেয়। এ ঘটনায় গণমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হননি ফরিদপুরের এসপি আবদুল জলিল।
যা ঘটেছিল ভাঙ্গায়:
গতকাল ছিল আন্দোলনের তৃতীয় দিন। এদিন ভোর থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভাঙ্গা মোড়ে জড়ো হয় আন্দোলনকারী। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের আলগি ইউনিয়নের সোয়াদী এলাকা থেকে শুরু হওয়া ‘লংমার্চ টু ভাঙ্গা’ দুপুর ১২টার মধ্যে গোলচত্বর এলাকায় এসে পৌঁছায়। বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র ছিল। ভাঙ্গা গোলচত্বরসহ আশপাশের এলাকায় হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অল্পসংখ্যক পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। দুপুর ১টার দিকে উত্তেজিত আন্দোলনকারী ভাঙ্গা চৌরাস্তার মডেল মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এপিবিএন ও পুলিশদের ধাওয়া করে। এ সময় এপিবিএন ও পুলিশ সদস্যরা পিছু হটে ভাঙ্গা মডেল থানায় অবস্থান নেয়। পরে আন্দোলনকারীরা ভাঙ্গা থানায় হামলা চালায়। তারা থানার ভেতরে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে থানার অভ্যন্তরে থাকা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এরপর আন্দোলনকারীরা উপজেলা চত্বরে গিয়ে উপজেলা প্রশাসনিক ভবন, নির্বাচন কমিশন অফিস ও অফিসার্স ক্লাবে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করে। পরে তারা ভাঙ্গা হাইওয়ে থানা অবরোধ করে রাখে। এবং দুই ইউনিয়নের হাজার হাজার জনগণ ভাঙ্গা চৌরাস্তার মোড়ে এসে অবস্থান নেয়। এতে ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উপজেলার হামিরদী ইউনিয়নের পুকুরিয়া থেকে আলগি ইউনিয়নের ডুমুরদিয়া পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তার বিভিন্ন স্থানে গাছের গুঁড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি ও টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক দু’টি অবরোধ করে রাখে বিক্ষোভকারীরা। এতে সড়কের দু’পাশে আটকে পড়ে শত শত পরিবহন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে সড়ক থেকে সরে যায় আন্দোলনকারীরা। এরপর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এদিকে, সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভাঙ্গা থানার সামনে অন্তত চার-পাঁচটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। পুরনো থানার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা কমপ্লেক্সে ঘটেছে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ। মিলনায়তনের চেয়ার-টেবিল, শোকেস গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ভাঙচুর হয়েছে জানালার কাঁচ। উপজেলা পরিষদের পুরনো ভবনের নিচতলার সব কার্যালয় ও নতুন তিনতলা ভবনের বিভিন্ন কক্ষেও হামলা হয়েছে। উপজেলা পরিষদের সামনে একাধিক মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অফিসার্স ক্লাব-সংলগ্ন গ্যারেজে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্লাবের এসি, লুট হয়েছে সিসি ক্যামেরা।
স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মী বলেন, আমরা যখন ভাঙচুরের ঘটনাগুলো ধারণ করছিলাম, তখন বিক্ষোভকারীরা আমাদের দিকে তেড়ে আসে। তারা ক্যামেরা ও মুঠোফোন কেড়ে নেয় এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পরে আমরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করি।
আন্দোলনকারীরা জানান, নির্বাচন কমিশন ফরিদপুরের-৪ আসনের ভাঙ্গা উপজেলার আলগি ও হামেরদী ইউনিয়নকে কেটে নিয়ে নগরকান্দা ও সালথা উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এর প্রতিবাদে এই আন্দোলন। তারা জানান, তাদের দাবি একটাই, ভাঙ্গা থেকে নগরকান্দা বা সালথায় যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দাবি মানা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আবদুল জলিল বর্তমানে ভাঙ্গা থানায় অবস্থান করছেন। আজকের ঘটনা নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমানও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। থানার ওসি, সার্কেল এএসপি’র সঙ্গেও ফোনে যোগাযোগ করা যায়নি। ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রকিবুজ্জামান বলেন, ‘জনগণ ঘরে ফিরে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা কাজ করছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রহরী মো. সামসু বলেন, তিনি হামলার সময় দোতলায় ইউএনও কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় শত শত লোক উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে। তার আগে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। যেসব অফিস খোলা ছিল, প্রতিটিতে ভাঙচুর চালায়। তবে যেসব কক্ষ বন্ধ ছিল সেগুলো ভাঙার চেষ্টা করেনি। কাউকে মারধরও করেনি।
উল্লেখ্য, ৪ঠা সেপ্টেম্বর গেজেটের মাধ্যমে ৩০০ আসনের সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। ভাঙ্গা উপজেলার আলগি ও হামিরদী ইউনিয়নকে ফরিদপুর-৪ আসন থেকে কেটে ফরিদপুর-২ আসনে যুক্ত করা হয়েছে। এরপর থেকে ভাঙ্গায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত রোববার থেকে তিনদিনের সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন স্থানীয় জনতা।