রণাঙ্গন ছেড়ে পালানো সৈন্যের সংখ্যা বাড়ছে, ক্লান্ত উদ্বিগ্ন ইউক্রেন বাহিনী
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দেওয়া বেসামরিক যোদ্ধারা এখন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাচ্ছেন।
২০২৩ সালের মে মাসে কিরিল বাবি পণ করেছিলেন, মাতৃভূমি ক্রিমিয়া রাশিয়ার দখল থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। বাবি ছিলেন ৪৩ ইউক্রেনিয়ান আর্টিলারি ব্রিগেডের একজন লেফটেন্যান্ট। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হলে স্থপতি হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ২০২৩ সালের শেষের দিকে তিনি ভেঙে পড়েন। ওই বছরের নভেম্বরে ইনস্টাগ্রামের পোস্টে তিনি লেখেন: “এক মাস আগে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম: ‘যদি পাঁচ বছর যুদ্ধ চলে, কিরিল?’ কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। আমি আরও তিন বছর যুদ্ধক্ষেত্রে কাটাতে চাই না। আমি ক্লান্ত।”
বাবি আরও লেখেন, ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তার দুই বছরের চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি ‘ভলেন্টারি ডিমোবিলাইজেশন’-এর মাধ্যমে তার রেজিমেন্ট থেকে বিদায় নেবেন। এটিই ছিল তার শেষ পোস্ট। কিরিল বাবি এরপর পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি নিখোঁজ।
ইউক্রেনীয় সংবাদমাধ্যমে প্রসিকিউটর জেনারেলের অফিসের ফাঁস হওয়া তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী থেকে ৪৫ হাজার ৫৪৩ জন সৈন্য পালিয়ে গেছেন। ২০২২ সালের সমগ্র বছরে এ সংখ্যা ছিল ৮১ হাজার ১৬৭। কিছু সামরিক কর্মকর্তার মতে, প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত এক লাখের বেশি, যা বর্তমানে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত মোট সদস্যের ১০ শতাংশের সমতুল্য।
বাবির এ ঘটনার মতো আরেকটি ঘটনা ইউক্রেনের জাতীয় পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং প্রথমবারের মতো অনেক ইউক্রেনীয় সংবাদমাধ্যম এটি নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করে। ৫৬ মোটরাইজড ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের সৈনিক সের্হি নেজদিলভ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা করেন, তার সামরিক দায়িত্বের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে না জানানো হলে তিনি বাহিনী ছেড়ে দেবেন।
অনেক ইউক্রেনীয় ঘুষ দিয়ে সশস্ত্রবাহিনীতে নিয়োগ এড়াচ্ছেন। এ দুর্নীতি দেখতে দেখতে তিনি বিরক্ত বলে জানান নেজদিলভ। সিকিউরিটি সার্ভিসেস অব ইউক্রেন (এসএসইউ) তাকে ৯ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে। সামরিক আইনের অধীনে তার বিরুদ্ধে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ ভলেন্টারি ডিমোবিলাইজেশন এবং বাহিনী ছেড়ে পলায়নকে [ডেজার্টার] আলাদাভাবে দেখে। প্রথমটি মোট সংখ্যার ৬৬ শতাংশ। এরা এমন সৈন্য যারা ছুটি নিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে আর রণাঙ্গনে ফিরে আসে না।
অন্যদিকে, পলাতকেরা হচ্ছেন তারা যারা না বলে-কয়ে হুট করেই বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে উভয় ক্ষেত্রেই এটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এর জন্য পাঁচ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে।
তবে সমস্যাটি এতটাই বিস্তৃত যে, ইউক্রেনের সংসদ ২০ আগস্ট একটি নতুন আইন অনুমোদন করতে বাধ্য হয়েছে। ওই আইনের অধীনে ভলেন্টারি ডিমোবিলাইজেশনে যাওয়া সৈন্যদের প্রথম সতর্কতার পর জরিমানা ছাড়াই সেনাবাহিনীতে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হবে।
‘পরিস্থিতি খুবই জটিল; আমরা এমনটা ভান করতে পারি না যে, এটি ঘটছে না। এ কারণেই আমরা জেনারেল স্টাফ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের বৈঠকে এটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি,’ স্থানীয় একটি রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন সংসদীয় ডেপুটি ফেদির ভেনিস্লাভস্কি।
গত এপ্রিলে ভলেন্টারি ডিমোবিলাইজেশনে যাওয়া এক অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছে এল পাইস। এ অফিসার এখন বাড়িতে অবস্থান করছেন এবং সামনের দিনগুলোতে নিজের ইউনিটে ফেরার তার কোনো ইচ্ছা নেই।
তিনি বলেন, তিনি বর্তমান যুদ্ধে দুবছরেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করছেন। এছাড়া ২০১৪ সালে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ডনবাসে লড়েছিলেন। তার মতে, তাই তিনি বেসামরিক জীবনে ফিরে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
ভলেন্টারি ডিমোবিলাইজেশন অথবা বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া — কেন দুটো ক্ষেত্রেই এখনো এত কম সৈন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন? আইনজীবী ও দ্য ভিঞ্চি ব্যাটালিয়নের মর্টার ইউনিটের কমান্ডার আন্দ্রি পিসারেঙ্কো বলেন, এর প্রধান কারণ হলো এসএসইউ-এর কাছে এত বেশি মামলা মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই।
পিসারেঙ্কোর অনুমান, সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে পালানোর সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু কিছু কমান্ডার হয় ঝামেল এড়াতে অথবা বন্ধুত্বের খাতিরে দলছুট সেনা বা কর্মকর্তাদের তথ্য ওপর মহলে জানান না।
এপ্রিলে এল পাইস-এর সঙ্গে আলাপ করা একজন পলাতক সৈন্য বলেন, ‘আপনি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে সেনাবাহিনীতে যান। কিন্তু বাস্তবে আপনি দেখতে পান যে, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আপনাকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আপনি জানেন না এ যুদ্ধ কখন শেষ হবে।’
কিরিল বাবি তার বিদায়ী বার্তায় লিখেছিলেন: ‘আমি চাই সেনাবাহিনীকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হোক, যেটি কারাগারের মতো আচরণ করবে না বরং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে পারে।’
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দেওয়া বেসামরিক যোদ্ধারা এখন তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাচ্ছেন। প্রায় কোনো সাধারণ ইউক্রেনীয়ই এখন আর বাহিনীতে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছেন না। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছেন, তারা মূলত সেখানে পৌঁছার পর আশাহত হচ্ছেন।
২০২৪ সালের এপ্রিলে ইউক্রেন সরকার নতুন মোবিলাইজেশন আইন পাস করে। ২০২২ সাল থেকে সক্রিয় কয়েক লাখ স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা আশা করেছিলেন, এ আইনের মাধ্যমে সরকার তাদের তিন বছরের চাকরির পর দেশে ফিরিয়ে দেবে।
কিন্তু ইউক্রেন সরকার এবং সশস্ত্রবাহিনীর বড়কর্তা উভয় পক্ষই এমন সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ তাদের পক্ষে এ মুহূর্তে সাধারণ সৈন্য হারানোরও উপায় নেই, আর অভিজ্ঞ সেনাদের ঘরে ফেরার অনুমতি দেওয়া তো আরও দূরের কথা।
জাপোরিঝিয়া ফ্রন্টে যুদ্ধরত একটি ব্রিগেডের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০২২ সালের গ্রীষ্মে তার ব্যাটালিয়নের থাকা সৈন্যদের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৫ শতাংম সক্রিয় রয়েছে। বাকিরা যুদ্ধে নিহত হয়েছেন অথবা আহত হয়ে চাকরি ছেড়েছেন।
এদিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য কেবল দেশটির বিশাল জনসংখ্যাই নয়, কঠোর নিয়োগ পদ্ধতিও রয়েছে। এছাড়া সৈন্যদের দল ছেড়ে পালানো থেকে নিরুৎসাহিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে রাশিয়া।
রাশিয়ান সৈন্যদের সাক্ষ্য এবং ফ্রন্টলাইনে থাকা ইউক্রেনীয় ড্রোনের ভিডিও প্রমাণ করে, রুশ সেনাদের যারা দলছুট হন, সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশটিতে একটি সাধারণ বিষয়।