রপ্তানি খাতে ভরাডুবির শঙ্কা
উৎপাদন কমেছে ৩০-৪০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতা শতাধিক কারখানা হয়েছে বন্ধ
অন্তর্বর্তী সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য পণ্য ও সেবা খাতে মোট ৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয়ের টার্গেট নিয়েছে। এর মধ্যে পণ্য খাতেই ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্য রয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণে আশাবাদী হতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। জ্বালানিসংকটের পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বেসরকারি খাতে ঋণসংকট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রপ্তানিমুখী শিল্পের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা কারণে সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি আয়ে ভরাডুবির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করে দ্রুত সমাধান চেয়েছেন বিভিন্ন শিল্পের ব্যবসায়ীরা। তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমই সম্প্রতি এনবিআরকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, শুধু কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়েছে। আরও বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছে, নানা সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রায় আয়ের অন্যতম উৎস্য হচ্ছে রপ্তানি খাত। নানামুখী সংকটে এখন এই খাত নিয়ে শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২৪ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় অর্জিত হয়েছে। সরকারি লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সামনের ছয় মাসে শুধু পণ্য খাতে আরও ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় করতে হবে।
শিল্পকারখানা মালিকদের আশঙ্কার জায়গাগুলো হচ্ছে- (১) শ্রম অসন্তোষ ও মূলধনসংকটে অনেক কারখানা বন্ধ রয়েছে; (২) উচ্চ সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছেন না; (৩) গ্যাস ও বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় শিল্পকারখানা পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না। উপরন্তু নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে বিনিয়োগ সম্প্রসারণেও উৎসাহ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা; (৪) উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক শিল্পের বিক্রি কমে গেছে; আবার পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় রড, সিমেন্টের মতো শিল্পগুলো পণ্যের দাম কমিয়েও টিকে থাকতে পারছে না; (৫) শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতার কারণেও পোশাকশিল্পসহ অনেক শিল্প সংকটে পড়েছে; অনেক কারখানা কাঁচামাল আমদানি করতে না পেরে উৎপাদন বন্ধ রাখতেও বাধ্য হচ্ছে। এসব কারণে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি খাত হুমকির মুখে পড়েছে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিল্পের সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সম্প্রতি এক বৈঠকে সংকটে পড়া বিভিন্ন শিল্পের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা ওপরের সমস্যাগুলো তুলে ধরেছেন। তারা বলেছেন, ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি- সবকিছু মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারছে না; চাহিদামতো এলসি ওপেন করা যাচ্ছে না; নতুন গ্যাস সংযোগে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে, আবার আইএমএফের সুপারিশে বিভিন্ন পণ্যের ওপর কর ও মূসক বাড়ানো হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে বৈঠকে গভর্নরকে জানানো হয়। বিসিআই প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী জানান, টাকার অবমূল্যায়ন আমলে না নিয়ে ব্যাংকের সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার ফান্ডেড ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ এবং ননফান্ডেড ১০ শতাংশ করা হয়েছে; রপ্তানিমুখী শিল্পের নগদ সহায়তা পেতে আবেদনের পর নয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। আরও কারখানা বন্ধ হবে। রপ্তানিকারকরা আমাদের কাছে নানা সংকট, অভিযোগ নিয়ে আসছেন। কোনো সমাধান হচ্ছে না।’ তৈরি পোশাক খাতের এই রপ্তানিকারক বলেন, ‘আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ জ্বালানি খাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যাংকিং খাত, কাস্টমস-সংক্রান্ত শর্ত- এসব সমস্যা সমাধান না হলে নিশ্চিতভাবে রপ্তানি আয় কমে যাবে।’