রাজস্ব খাত সংস্কারে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের খসড়া
স্বতন্ত্র পলিসি ইউনিট গঠনের সুপারিশ
রাজস্ব খাত সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রশাসন ও নীতি (পলিসি) উইং পৃথক করার বিষয়ে সুপারিশ করতে যাচ্ছে।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে এবং করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করতে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারাও চাইছেন পৃথক দুটি সংস্থার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে প্রশাসন ও নীতি বিভাগ আলাদা করার পর নীতি বিভাগে কোন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করবেন, অফিস কোথায় হবে, পদমর্যাদা কী হবে। এ নিয়ে দুই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। দুই অ্যাসোসিয়েশন শ্বেতপত্রের সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার চাইছে।
জানা গেছে, রাজস্ব খাত সংস্কারে গঠিত পরামর্শক কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়ার জন্য একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের খসড়া তৈরি করেছে। আজ কমিটির সদস্যরা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে আলোচনায় বসার কথা রয়েছে।
খসড়া প্রতিবেদনে আইআরডির অধীনে নীতি বিভাগ পরিচালনার রূপরেখা আছে। যদিও পরামর্শক কমিটিকে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন বলেছে, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে এবং করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে এনবিআরের সংস্কার চাইলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা পদ্ধতিতেই এ কাজ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এনবিআরকে আইআরডির অধীন থেকে বের করে সরাসরি অর্থমন্ত্রী/অর্থ উপদেষ্টার অধীনে দুটি সংস্থা গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। সংস্থা দুটির প্রধান হবেন কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
১৫ ডিসেম্বর দুই অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পরামর্শক কমিটিকে একটি উপস্থাপনা দেওয়া হয়। এতে পার্শ্ববর্তী দেশ ও উন্নত দেশগুলো কীভাবে রাজস্ব আদায় করে তা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার চাপিয়ে দেওয়া সংস্কার মডেল বাংলাদেশের রাজস্ব খাতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। যেমনটি হয়েছে শ্রীলংকার ক্ষেত্রে। দাতা সংস্থার পরামর্শে শ্রীলংকার রাজস্ব খাত সংস্কার করতে গিয়ে দেশটির কর-জিডিপি অনুপাত তিন বছরের ব্যবধানে ১১ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
প্রকৃত সংস্কারের জন্য এনবিআরের প্রশাসন ও নীতি উইং আলাদা করতে হবে। দুটো বিভাগই আইআরডির পরিবর্তে অর্থমন্ত্রী/অর্থ উপদেষ্টার অধীনে থাকবে। আর সংস্থা দুটির প্রধান হবেন কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তারা। করদাতাবান্ধব ও রাজস্ববান্ধব নীতি প্রণয়নের জন্য নীতি বিভাগে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করবেন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, হিসাববিদ, ব্যবসায়ী নেতা, গবেষণা কাজে যুক্ত ব্যক্তি, পেশাজীবী, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। পক্ষান্তরে প্রশাসনিক উইং রাজস্ব আদায়, নীতি বাস্তবায়নের কাজ করবে।
জানতে চাইলে রাজস্ব খাত সংস্কার কমিটির প্রধান ড. আব্দুল মজিদ বলেন, এনবিআর নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাই এনবিআর সংস্কারে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন একেবারে দেওয়া সম্ভব নয়। ধাপে ধাপে কমিটি সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবে। সমস্যাগুলো দূর করতেও সরকারকে সংস্কার কাজ চলমান রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, সংস্কারে সুপারিশ দেওয়ার আগে ব্যবসায়ী নেতা/করদাতা ও কাস্টমস-আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হচ্ছে।
রোববার (আজ) কমিটির সদস্যদের একটি বৈঠক আছে। বৈঠকে সদস্যরা ঐকমত্যে পৌঁছলে এনবিআরের পলিসি ইউনিট পৃথক করার বিষয়ে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে দেওয়া হতে পারে। এই প্রতিবেদনে কীভাবে পলিসি ইউনিট আলাদা করা হবে, তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকবে।
৯ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংক গ্রুপ এনবিআরের সঙ্গে নীতি ও প্রশাসনিক সংস্কার বিষয়ে আলোচনায় বসে। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ সংস্কারের দুটি মডেল উপস্থাপন করে বলা হয়েছে-অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা ও কানাডায় ট্যাক্স পলিসি ইউনিট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে।
অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, স্পেন, রাশিয়া ও নিউজিল্যান্ডে রাজস্ব প্রশাসনের অধীনে ট্যাক্স পলিসি ইউনিট কাজ করে। সব দেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান কার্যকর নাও হতে পারে।
দুই ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের প্রায় দেশে রাজস্ব বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকে। এজেন্সির প্রধানরা ট্রেজারি প্রধান অথবা অর্থমন্ত্রীকে রিপোর্ট করেন। অথচ বাংলাদেশে এনবিআর কাজ করে আইআরডির অধীন একটা বিভাগ হিসাবে। আইআরডির সচিব পদাধিকার বলে এনবিআরের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও আদায় বিশেষায়িত কাজ হওয়ায় বেশিরভাগ সচিবের রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না।
এনবিআরের সক্ষমতায়ও রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে শুধু নামকাওয়াস্তে রাজস্ব প্রশাসন ও রাজস্ব নীতি বিভাগকে আলাদা করলে চলবে না, এর পাশাপাশি সংস্থা দুটিতে লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়াসহ কাঠামোগত আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। তা না হলে সংস্কার শ্রীলংকার মতো রাজস্ব ধসের অভিশাপ বয়ে আনবে।
এনবিআর নিয়ে শ্বেতপত্রে যা আছে : বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের সমস্যা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। শ্বেতপত্রে এনবিআরের নানা সীমাবদ্ধতার কথা উঠে এসেছে। বিশেষত নীতি প্রণয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিশ্লেষণে স্বায়ত্তশাসন ও দক্ষতার ক্ষেত্রে এনবিআরের সীমাবদ্ধতা আছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগ বিশ্লেষণাত্মক কাজে দক্ষ নয়। এছাড়া ঘন ঘন নেতৃত্বের পরিবর্তন অর্থবহ সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করছে। পাশাপাশি এনবিআর স্বেচ্ছাসেবী কমপ্লায়েন্সকে উৎসাহিত করার পরিবর্তে এনফোর্সমেন্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, এনবিআরে চেয়ারম্যান নিয়োগের বর্তমান প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর প্রশাসন ও শাসনের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
শুরুতে এনবিআর চেয়ারম্যান হতেন এনবিআরের একজন সদস্য। পরবর্তী ১৯৭৯ সালে অ্যাডমিন ক্যাডার কর্মকর্তাদের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। এ ধরনের নিয়োগ এনবিআর প্রশাসনে সদস্যার সৃষ্টি করেছে। রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবিহীন সচিবরা পদাধিকারবলে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ পাওয়ায় এনবিআর একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়াতে পারেছে না। এনবিআরে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং চেয়ারম্যানের কাজের মেয়াদ কমপক্ষে তিন বছর করার কথা শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে।
আয়কর ক্যাডার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শামীম বুলবুল বলেন, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন অত্যন্ত বিশেষায়িত কাজ। এর জন্য রাজস্ব কাজে গভীর জ্ঞান ও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকার প্রয়োজন। সারা বিশ্বে যেখানে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের মাধ্যমে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করা হয়, সেখানে মন্ত্রণালয়ের আমলাদের হাতে রাজস্ব নীতি প্রণয়ন দায়িত্ব তুলে দিয়ে দেশের অর্থনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার ঝুঁকিপূর্ণ পরামর্শ কেন দেওয়া হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশের সামগ্রিক রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও আদায় কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে, যা কোনোভাবে কাম্য নয়।
কাস্টমস ক্যাডার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নূরুল হুদা আজাদ বলেন, যেভাবে নামেই হোক বা যেই সংস্থার অধীনেই হোক-রাজস্ব নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হাতে ন্যস্ত থাকা উচিত। কারণ এই দুই ক্যাডার রাজস্ব নীতি প্রণয়নে বিশেষায়িত। পলিসি আলাদা করার নামে অন্য কোনো বিভাগ বা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। বিষয়গুলো জানিয়ে কাস্টমস ক্যাডার থেকে পরামর্শক কমিটির কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।