রাজস্ব ঘাটতি আরও বেড়েছে, অক্টোবরে হয়েছে ৪,১০০ কোটি টাকা
আমদানি কমে যাওয়াকে অন্যতম কারণ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজস্ব আদায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সাথে তাল মেলাতে পারছে না, ফলে এই ব্যবধান বাড়ছেই। শুধুমাত্র গত অক্টোবর মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা। আগের তিন মাসের প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির সাথে নতুন এই অঙ্কও যোগ হলো।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)- এর তথ্যমতে, অক্টোবরে ৩১ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
রাজস্বের কর্মকর্তারা এজন্য ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে বিধিনিষেধের মতো প্রতিকূলতাকে দায়ী করেন, যার ফলে আমদানি কর আদায় ব্যাহত হচ্ছে। অর্থনীতির মন্থর অবস্থার কারণেও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায়– প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে কম হচ্ছে, এবং করফাঁকি রোধে এনবিআরের সীমিত সক্ষমতাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী মাসগুলোতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা আরো বেশি হবে। অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি নেই। ফলে এই ঘাটতি আরো বাড়তে পারে, এবং বছর শেষে নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা তো নয়ই, এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীও রাজস্ব আদায় করতে সমর্থ্য হবে না এনবিআর।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত চার মাসে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আমদানি কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং আয়কর মিলিয়ে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার কম।
আলোচ্য সময়ে (জুলাই- অক্টোবরে) আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এই সময়ে, ভ্যাট ও আয়কর উভয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ করে, অথচ আমদানি কর আদায়ে এ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৯ শতাংশ।
রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য (শুল্ক নীতিমালা) মো.লুৎফর রহমান রহমান দেশের বাজারে ডলার সংকট এবং ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াকে আমদানি কমে যাওয়ার জন্য দায়ী করেছেন।
তিনি বলেন, “ইমপোর্ট ট্যাক্স এর যে গ্রোথ দেখা যাচ্ছে, তা মূলত আমদানি পণ্যের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমদানি বাড়েনি।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২৪ শতাংশ।
আইএমএফ- এর ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত পূরণ করতে – চলতি অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে – সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় এক সফরে তা কমিয়ে আনতে সম্মতি দিয়েছে সংস্থাটির প্রতিনিধি দল। কমিয়ে আনা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলেও আদায়ে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে কাস্টমস বিভাগ মনে করছে, আমদানির বিদ্যমান অবস্থায় গতি না আসলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে।
গত ২৭ নভেম্বর, এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি জানতে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। সভায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় বাড়াতে কর্মকর্তাদের কৌশল খোঁজা, বকেয়া ও মামলায় আটকে থাকা রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং ফাঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে বৈঠকের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সে তুলনায়, গত অর্থবছর আদায় হয়েছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এনবিআরকে গড়ে প্রতি মাসে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে প্রায় ৩০ শতাংশ হারে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান– পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এত বেশি হারে রাজস্ব আদায় করা বর্তমান বাস্তবতায় সম্ভব নয়।
বলেন, ‘অর্থনীতিতে গতি কম, রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি এনবিআরের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য যেসব সংস্কার করা দরকার ছিল, এনবিআর তা করতে পারেনি। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে না।’
এমনকি আইএমএফ এর কমিয়ে আনা লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।