Bangladesh

রাজস্ব মেরে ফেঁসে যাচ্ছেন ৯০ মালিক-কর্মকর্তা

বিপুল অঙ্কের ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে কক্সবাজারের প্রায় ৭০টি হোটেল-মোটেল। এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের অন্তত ২০ অসাধু কর্মকর্তাকে মোটা দাগের ঘুষ দিয়েছেন। গত দুই মাস অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাথমিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠান ও সরকারি কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অনুসন্ধান কার্যক্রমের নেতৃত্বে আছেন দুদক কক্সবাজারের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন। 

তিনি বলেন, ‘বিষয়টির আরও অনুসন্ধান চলছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে আমরা কয়েকটি হোটেলে ভ্যাট ফাঁকির চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি।’

সূত্র জানায়, ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে ইতোমধ্যে ৩০টি আবাসিক হোটেল-মোটেলের মালিকদের চিঠি, কয়েকটির নথিপত্র জব্দ ছাড়াও বেশ কয়েকজন ভ্যাট কর্মকর্তা ও হোটেল মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি ও হোটেল ডায়মন্ডের কর্ণধার আবুল কাশেম শিকদার, শালিক রেস্তোরাঁর মালিক নাছির উদ্দীন, আলগণি রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রুবেল উদ্দিন, কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের সহকারী কমিশনার আল আমিন, সুশান্ত পাল, রাজস্ব কর্মকর্তা হারুনুর রশীদ, সব্যসাচী সিকদার, মুজিবুর রহমান, মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন মজুমদার, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আশিকুর রহমান, তৌফিক আহমেদ, আবদুল কাদের, সালাহ উদ্দিন, আনিসুল করিম ও সৈয়দ মোহাম্মদ আবু রাসেল। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও চিঠি এবং জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক।

এ ছাড়া গোল্ডেন হিল, ভিস্তা বে, কোরাল রিফ, রয়েল প্লেস, বিচওয়ে, বিচ ভিউ, কক্সইন, হানিমুন রিসোর্ট, মোহাম্মদিয়া গেস্ট হাউস, হাইপেরিয়ান, সি-কুইন, হোটেল হাইপেরিয়ান বে, ইউনি রিসোর্ট, বসতি বে রিসোর্ট, ওয়াটার অর্কিড, হোটেল সি-কক্স, হোটেল আলবাট্রোস, সুগন্ধা গেস্ট হাউস, কোস্টাল পিস, লেগুনা বিচ, হোয়াইট বিচ, ডায়মন্ড প্লেস, হোয়াইট অর্কিড, জক্স বিচ রিসোর্ট, কক্স বিচ রিসোর্ট, হাইপেরিয়ান, সি ওয়ার্ল্ড, কোস্টারিকা, স্বপ্নালয় স্টুডিও, ঊর্মি গেস্ট হাউস, সুইট সাদাব ও উইন্ডে টেরিস, হোটেল সি-গাল, কক্স টুডে, শালিক ও পউসি রেস্তোরাঁকে চিঠি দিয়েছে দুদক।

অভিযোগ অস্বীকার করলেও দুদক ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানিয়েছেন কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের কক্সবাজার সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন মজুমদার। তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমি মাত্র কয়েক মাস এখানে এসেছি। এ সময়ে ভ্যাট ফাঁকি দূরের কথা, আমি সার্কেলের রাজস্ব আয় কয়েক গুণ বাড়িয়েছি। কক্সবাজারে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে ৩৯টি হোটেলের বিরুদ্ধে আমাদের মামলা ও অডিট চলছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় তারকা আবাসিক হোটেল বেস্ট ওয়েস্টার্ন হেরিটেজ বা গ্র্যান্ড হেরিটেজ ২০১৯-২১ অর্থবছরে বিক্রয় তথ্য গোপন করে প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকি দেয়। পরে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ মামলা করে। একইভাবে শহরের লাবনী পয়েন্টে সৈকতসংলগ্ন আবাসিক হোটেল কল্লোল ও একই মালিকানাধীন কাসুন্দি রেস্তোরাঁয় ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা করে কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ।
হোটেল কল্লোল ও কাসুন্দি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেছেন, ‘কাস্টমস বিভাগের মামলার জবাবে আমরা রিট করেছি। পরে আদালত কাস্টমস বিভাগের মামলার সব কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন।’

ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠায় হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইসে অডিটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কাস্টমস বিভাগ। পরে অ্যাকাউন্ট লেনদেনকারী সব ব্যাংকের হিসাব বিবরণী, ক্রয়-বিক্রয় রেজিস্ট্রারসহ ১১ ধরনের তথ্য চেয়ে গত ৮ অক্টোবর চিঠি দেয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালে দুদক কক্সবাজারে হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভ্যাট ফাঁকি নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান চালায়। ওই সময় দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২-এর সহকারী পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন, রতন কুমার দাস ও উপসহকারী পরিচালক শরিফ উদ্দিন স্বাক্ষরিত তদন্ত প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, কক্সবাজারে প্রায় প্রতিটি হোটেল-রেস্তোরাঁয় রুম বরাদ্দ, খাবার বিক্রির প্রকৃত সংখ্যা না দেখিয়ে কাস্টমস ভ্যাট কর্মকর্তাদের অবৈধ মাসোহারা দিয়ে ভ্যাটের টাকা দিচ্ছেন না। বিস্তারিত অনুসন্ধান হলে ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া প্রতিরোধের পাশাপাশি বাড়বে রাজস্ব আদায়।

দুদকের প্রতিবেদনে ২০২০ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায়ের তুলনামূলক একটি চিত্রও দেওয়া হয়। এতে আয়ের পরিমাণ কম দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রায় তিন বছর পর সম্প্রতি নতুন করে বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, মাসোহারার বিনিময়ে কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁগুলো দীর্ঘদিন ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। বেশির ভাগ হোটেল মালিকও স্বীকার করেন– যে ভ্যাট আসে তার চেয়ে দ্বিগুণ ঘুষ দিতে হয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের। বিনিময়ে তারাও প্রায় তিন গুণ ভ্যাটের দায়মুক্তি পান। ভ্যাটের চেয়ে ঘুষ আদায়ে এসব কর্মকর্তা বেশি তৎপর থাকেন।

কক্সবাজারের হোটেল, মোটেল ও গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেছেন, ‘হাইকোর্টের একটি নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করছে। ওই মামলায় আমরাও পক্ষভুক্ত হয়েছি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসা করে।’

জড়িত প্রমাণ পেলে হোটেল মালিক ও দুদক কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)- এর কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান।
কক্সবাজার কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের যুগ্ম কমিশনার শাকিল খন্দকার সমকালকে বলেছেন, ‘টাকা আদান-প্রদানে কাস্টম বিভাগের লোকজনের সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ক্রেতা টাকা দেন, বিক্রেতা সেগুলো সরাসরি ব্যাংকে জমা দেন। কাস্টমসের লোকজন বিষয়টি তদারকি করেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সরকারি কোনো সংস্থা অনুসন্ধান করলে তারা তাদের মতো করে প্রতিবেদন জমা দেবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button