Hot

রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন অনিশ্চিত, কমিটির সদস্যদের মতবিরোধ তুঙ্গে

রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন এক রকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের অনেকে জানিয়েছেন, কমিটির সদস্যদের নানামুখী বক্তব্য সার্বিক কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে রীতিমতো এক ধরনের ‘তামাশা’ চলছে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে এমন চিত্রই বেরিয়ে এসেছে।

রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান জানিয়েছেন, আমরা একটি তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। যাচাই-বাছাই শেষে তা প্রকাশ করা হবে।

কমিটির আরেক সদস্য সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদও বলেছেন, একটা তালিকা তৈরি করে তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, তার কাছে কোনো তালিকা আসেনি। আলাপ-আলোচনা হলেও শাজাহান খানের কমিটি এখনও কোনো তালিকা দিতে পারেনি। অপরদিকে কমিটির আরেক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম বলেছেন, তিনি কমিটিতে থাকতেই চাননি। তার নাম জোর করে ঢোকানো হয়েছে।

রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন নিয়ে এই যখন অবস্থা তখন বিশ্লেষকদের অনেকে বিষয়টি নিয়ে যুগান্তরের কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, আমি বলব রাজাকারের তালিকা কেউ করতে চায় না। ৭২ সালের তালিকা তো আছেই। এছাড়া নতুন করতে গেলে সমস্যা হবে। অনেকে এগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জ করে বসবেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে এবং ৩ বছর সে মামলা আমাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। সুতরাং বাস্তবে কেউ এ তালিকা করায় আন্তরিক নন বলে তিনি মনে করেন।

পাকিস্তান সরকারের তালিকা নিয়ে মন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থান : রোববার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রণীত রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকাই প্রকৃত তালিকা। কারণ রাজাকারদের তালিকা তো তৎকালীন সরকার প্রণয়ন করেছে এবং রাজাকারদের তারা বেতন-ভাতা দিত। নতুন করে তালিকা করতে গেলে সেই তালিকায় ভেজাল ঢুকতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান সরকারের তৈরি করা তালিকাকে প্রকৃত ও নির্ভুল তালিকা মনে করি।

তিনি বলেন, সেই তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসে সংরক্ষিত। সেই তালিকার একটি কপি আমার সংগ্রহে আছে। দরকার হলে তা আপনাদের দেখাতে পারি। মন্ত্রী আরও বলেন, আমরা ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছি। যা পাকিস্তান সরকারের সময় প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু সেই তালিকার বিরুদ্ধে সাংবাদিকরাই সোচ্চার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে শাজাহান খানকে প্রধান করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। সেই কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত তালিকা আমাকে দেয়নি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৭১ সালে অনেকে বাধ্য হয়ে রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, সেই মন্ত্রিসভায় কি সবাই স্বেচ্ছায় শপথ নিয়েছে? বরং বন্দুকের নলের মুখে অনেকে শপথ নিতে বাধ্য হয়েছে। সুতরাং ১৯৭১ সালেও অনেকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যারা বাধ্য হয়ে রাজাকার হয়েছে তাদের সংজ্ঞা কি হবে? আর যারা প্রকৃত রাজাকার ছিল, তারা তো পাকিস্তানিদের তালিকায় ভাতাভোগী। বিষয়গুলো নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা আছে। তাহলে কি রাজাকারের তালিকা হচ্ছে না-এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘হবে। হবে না কেন? বলতে পারেন কাজ চলছে।’

আংশিক তালিকা প্রকাশ থেকে পিছু হটল কমিটি : রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা প্রণয়ন উপকমিটির সভাপতি এবং সাবেক নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, দেশের ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৫০টি উপজেলার রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসের তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। আরও যাচাই-বাছাই হচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে আংশিক তালিকা প্রকাশ না করে একসঙ্গে সব রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে। কারণ আংশিক তালিকা প্রকাশ করলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন কাজের মধ্যে আছি।

রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, যতটা সম্ভব কাজ করে আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। সব উপজেলার তথ্য পাওয়া যায়নি। ৫৩ বছর হয়ে গেছে। অনেকে অনেক কিছু ভুলে গেছেন। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের নাম এসেছে তাদের সময়কার সাক্ষ্য লাগবে। এখন সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে না। যাচাই- বাছাই করে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে হবে। কাজটি বেশ জটিল। তবে মনে রাখতে হবে, এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া।

রাজাকারদের সাহায্য করার বয়ান : কমিটির আরেক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কমিটিতে থাকতেই চাইনি। শাজাহান খান আমার নাম দিয়েছেন। জেলায় জেলায় আনসারের উপপরিচালকের (ডিডি) কাছে রাজাকারের তালিকা আছে। জেলা থেকে যে তালিকাগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো তো ইতোমধ্যে জামুকায় জমা দেওয়া হয়েছে। অনেক রাজাকার মারা গেছে। মনে রাখতে হবে, এটা একটা জনযুদ্ধ ছিল। অন্য দশটি কাজের সঙ্গে রাজাকাররা ব্রিজ পাহারা দিত। আমি যখন কাওরানের ব্রিজ ভাঙতে যাই, তখন রাজাকাররা আমাদের অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। রাজাকাররা আমাদের বলেছে, পাকিস্তান আর্মির গাড়ি দেখলে আমরা রেললাইনে লোহা দিয়ে ৫টি আঘাত করব। তখন আপনারা লুকিয়ে থাকবেন। আবার যখন পাকিস্তান আর্মির গাড়ি চলে যাবে, তখন আমরা রেললাইনে লোহা দিয়ে ৩টি আঘাত করব। তখন আপনারা বেরিয়ে আসবেন। এভাবে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। তিনি আরও বলেন, বর্ডারের স্মাগলাররা মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তান আর্মির গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে, তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। দেশে কোনো কাজ নেই, অভাবে পড়ে অনেকে রাজাকারের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অনেকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকারে যোগ দিতে হয়েছে। তাদের আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন।’

তিনি আরও বলেন, নির্ভুল তালিকা করতে হলে অনেক বছর সময় লাগবে। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে তালিকা করতে হবে। কেউ একজন তালিকা করে এনে আমাকে দেবে আর আমি সেই তালিকায় স্বাক্ষর করব, তা আমি করব না। কাজটা বেশ কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। নিজে ইন্টারভিউ নিয়ে যতক্ষণ না আমি সন্তুষ্ট হব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি কেন দায়িত্ব নেব? কাজটা ইবাদতের ন্যায় করতে হবে। একজন রাজাকারের নাম বাদ যাক এটা যেমন চাচ্ছি না, তেমনি আরেকটা ভালো লোকের নাম রাজাকারের তালিকায় আসুক সেটাও চাই না। আমি সময় দিতে পারিনি এবং পারব না। তারপরও কমিটিতে আমার নাম রাখা হয়েছে। আর সময় না দিয়ে কারও তৈরি করা তালিকায় আমি স্বাক্ষরও করতে পারব না। তিনি আরও জানান, তালিকা প্রণয়নের বিষয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন শাজাহান খান।

সব উপজেলার রাজাকারের নাম না পাওয়া এবং অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা আত্মীয়স্বজনরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এমনটিই জানিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আলশামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন-হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে তারা।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তবে ওই তালিকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর ও ভাষাসৈনিক সদ্যপ্রয়াত গোলাম আরিফ টিপুসহ আরও অনেকের নাম আসে ওই তালিকায়। অথচ তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ছিলেন বলে প্রমাণ রয়েছে। এ নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা শুরু হলে বিতর্কের মুখে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করেছিল মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইট থেকে তালিকাটি সরিয়ে ফেলা হয়। পরবর্তী সময়ে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) আইন-২০২২ সংশোধিত আকারে পাশ হওয়ার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় ২০২২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। এতে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীর মধ্যে রাজাকারের তালিকা তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হয় জামুকাকে।

আইনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বা আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপ দ্বারা নিরীহ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছেন অথবা একক বা যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তক্রমে প্রত্যক্ষভাবে, সক্রিয়ভাবে বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন তাদের তালিকা প্রণয়ন ও গেজেট প্রকাশের জন্য জামুকা সরকারের কাছে সুপারিশ প্রেরণ করবে।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজাকারের তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হলে অনেকে জানিয়েছেন তাদের জেলার রেকর্ড রুমে রাজাকারদের নামের কোনো তালিকা নেই। কমিটির সদস্যরা জেলা ও উপজেলায় গিয়েও সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। অনেকে শত্রুতা করে কারও নাম দিতে পারে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হচ্ছে তাদের। আবার অনেক রাজাকার বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থাকায় বা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের সম্পর্কে অনেকে তথ্য দিতেও অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto