রাশিয়ায় যুদ্ধে আট বাংলাদেশি!
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন বাংলাদেশের রাজবাড়ীর ছেলে আরমান মণ্ডল। ইউক্রেনের ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার মাইন বিস্ফোরণে আক্রান্ত হওয়ার দাবি করেন তিনি। ২১ বছর বয়সী এই তরুণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কিভাবে জড়ালেন, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে কালের কণ্ঠ। এতে বেরিয়ে আসে একটি এজেন্সির ভয়াবহ প্রতারণার তথ্য।
বিভিন্ন কারখানা ও ক্যান্টনমেন্টে মালি বা বাবুর্চির কাজ দেওয়ার কথা বলে তরুণদের পাঠানো হয় রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। শুধু এক এজেন্সির মধ্যস্থতায় পাঠানো ১০ তরুণের মধ্যে আটজন যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে অনেকের কোনো খোঁজ মিলছে না।
গতকাল সোমবার আহত আরমানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন কালের কণ্ঠ প্রতিবেদক। আরমান এ সময় চিকিৎসাধীন ছিলেন রাশিয়ার একটি সামরিক হাসপাতালে। ভিডিও কলে তিনি বলেন, ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরবে নেওয়া হয় তাঁদের। এরপর তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয় রাশিয়ান একটি চক্রের কাছে।
সেখানে এক মাস সশস্ত্র প্রশিক্ষণের পর গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে গোলাবারুদ নিয়ে রওনা দেন কিয়েভের দিকে। এ সময় ইউক্রেনের ছোড়া ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে অন্য সৈনিকদের সঙ্গে ছিলেন তিনিও। সেখানে স্থলমাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে তিনি আহত হন। এ সময় তিনি দুই পায়ের ব্যান্ডেজ দেখান।
আরমানের বাড়ি রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মাজবাড়ী ইউনিয়নের কুষ্টিয়াডাঙ্গি গ্রামে। তাঁর বাবা আকরাম মণ্ডল কৃষিকাজ করে সংসার চালান। আরমান কালিয়াকান্দি মীর মোশারফ কলেজে পড়াশোনা করতেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে স্থানীয় দালাল মনজুরুল হোসেনের প্রলোভনে পড়ে রাশিয়ায় যাওয়ার আগ্রহ দেখান। মনজুরুল তাঁকে নিয়ে যায় ড্রিম হোম ট্রাভেল নামে একটি এজেন্সির অফিসে। এজেন্সিকে আট লাখ টাকা পরিশোধ করে উন্নত জীবনের খোঁজে দেশ ছাড়েন আরমান। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিজের জীবন এখন বিপন্নপ্রায়।
ড্রিম হোম ট্রাভেল এজেন্সির ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, ‘বিশ্বব্যাপী ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত’ খোলার মতো চটকদার বিজ্ঞাপনে সয়লাব প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজ। বিশেষ করে রাশিয়া, কানাডা, সাইপ্রাস, চীনসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থী ও শ্রমিক পাঠানো হয় বলে উল্লেখ করা হয়। কোনো নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সি না হয়েও এভাবে প্রকাশ্যে বিদেশে শিক্ষার্থী ও কর্মী পাঠানোর বিষয়টিকে প্রতারণা বলছেন প্রবাসীকল্যাণ খাতের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ওমরা ভিসা দিয়ে নিয়ে সেখান থেকে ইউক্রেনে পাঠানো খুবই অন্যায় একটা কাজ। এ কাজের জন্য এটাকে এক ধরনের যুদ্ধ পাচার বলা যায়। এই ঘটনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অতি দ্রুত এই ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে দ্রুত কার্যক্রম প্রয়োজন। এর সঙ্গে দোষী ব্যাক্তিকে অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। এই ট্রাভেল এজেন্সিকে পাচারের আইনে বিচার করতে হবে।
ট্রাভেল এজেন্সির ভয়াবহ প্রতারণায় সংকটে অনেকে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আরমানসহ নিখোঁজ তরুণদের রাশিয়ায় চক্রের হাতে তুলে দেওয়ার এই লোমহর্ষক ঘটনায় নাটের গুরু ড্রিম হোম ট্রাভেল। এটি জননী গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর বনানীর এফ ব্লকে ৪ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়িতে এর কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নড়াইলের বাসিন্দা এম এম আবুল হাসান। তিনি নড়াগাতী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
আরমান মণ্ডলের সঙ্গে তিনি গত বছরের ১২ অক্টোবর ৩০০ টাকার দলিলে একটি চুক্তিতে সই করেন। চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, রাশিয়ার ক্যান্টনমেন্টে মালি অথবা বাবুর্চির কাজ দেওয়া হবে আরমানকে। বেতন হবে প্রায় দুই লাখ টাকা। ভিসার মেয়াদ হবে ১০ বছর। চুক্তিপত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকা নেওয়ার তথ্য থাকলেও বাস্তবে আরমানের কাছ থেকে দুই ধাপে আট লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর বাবা আকরাম মণ্ডলের।
আরমানের রাশিয়ার ভিসার একটি কপি কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ভিসাটি ইস্যু হয়েছে গত ৫ ডিসেম্বর। ভিসার মেয়াদ ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে ৬ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ৩০ দিন। ১০ বছরের কর্মী ভিসা দেওয়ার কথা বলে মাত্র এক মাসের পর্যটক ভিসা দেয় ট্রাভেল এজেন্সি। এভাবে এজেন্সির সূক্ষ্ম কারসাজিতে ফেঁসে গেছেন নিরীহ তরুণ আরমান মণ্ডলসহ কয়েকজন। আরমান ছাড়া বাকিরা হলেন—নরসিংদীর তুহিন, সোহান ও মোবারক; ঢাকার আমিনুল; গাইবান্ধার হুমায়ুন কবির ও রহমত আলী ও আকরাম।
জানা গেছে, ড্রিম হোম ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান আবুল হাসান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামান্না ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসার আড়ালে বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। কার্যত তাদের কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির নিবন্ধনও নেই। স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে নিরীহ ছেলেদের মস্তিষ্কে উন্নত জীবনের আশা জাগিয়ে বিপদে ফেলছেন।
যেভাবে যুদ্ধের মাঠে তাঁরা
গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বব ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেয় ড্রিম হোম ট্রাভেলস। এতে বলা হয়, রাশিয়ায় ক্যান্টনমেন্টে মালি ও বাবুর্চির কাজের সুযোগ রয়েছে। বেতন শুরু দেড় হাজার ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার তথ্যও তুলে ধরা হয় এতে।
ফেসবুকে চটকদার বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে স্থানীয় দালালদেরও কাজে লাগিয়ে দেয় ড্রিম হোম ট্রাভেলস। দালালরা উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের। সরল মনে তা বিশ্বাস করেন কলেজপড়ুয়া আরমানসহ অন্যরা। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালরা এই তরুণদের ঢাকায় ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে নিয়ে আসে। একেকজন থেকে নেওয়া হয় আট লাখ টাকা করে।
আরমান কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা চুক্তি করে ড্রিম হোম ট্রাভেলস। তিনিসহ ১০ জন তরুণকে প্রথমে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরবে পাঠায় ড্রিম হোম ট্রাভেল। সেখান থেকে তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয় রাশিয়ান একটি চক্রের কাছে। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁদের এক মাসব্যাপী কমান্ডো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কৌশলে দুজন দেশে ফিরে আসতে সমর্থ হলেও ফেঁসে যান বাকি আটজন। তাঁদের জোরপূর্বক মারধর করে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।
আরমান বলেন, ‘আমরা বারবার তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমাদের কর্মী ভিসায় পাঠানো হয়েছে। আমরা কোনো যুদ্ধে অংশ নিতে চাই না। এর পরও আমাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়। রাশিয়ান কমান্ডোরা মারধর করে আমাদের যুদ্ধে নিয়ে যায়। আমাদের সামরিক পোশাক পরিয়ে হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে দেওয়া হয়। কিয়েভে ড্রোন হামলা ও স্থলমাইন বিস্ফোরণ হলে আমার সামনে থাকা জিপে আটজনই প্রাণ হারান। আমি পেছনে মোটরসাইকেলে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। আমি এখন দেশে ফিরতে চাই।’
পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরমানের জন্ম ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে যে সৈনিক নম্বর দেওয়া হয়েছে, তার একটি ছবিও পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত ছবিতে দেখা গেছে, তাঁর আইডি নম্বর এ৫-১৯৭০৫৯।
‘আমার কলিজার টুকরা ছেলেকে ফেরত চাই’
দুই মেয়েকে জড়িয়ে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেন আরমানের মা ফাহিমা বেগম। একমাত্র ছেলের এমন জীবনসংকটে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আকরামও পাথর হয়ে গেছেন। আরমানের দুই ছোট বোনও ভাইয়ের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।
গতকাল কথা বলতে গিয়ে বারবার আহাজারি করছিলেন ফাহিমা। বারবার ছেলেকে নিরাপদে দেশে ফেরত আনতে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা, আমার একমাত্র ছেলে। আমি ছেলের জীবন ভিক্ষা চাই। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনুন।’
আরমানের বাবা আকরাম মণ্ডল বলেন, ‘আমার ছেলেটারে কাজের কথা বলে রাশিয়ায় নিয়ে দালালরা বিক্রি করে দিয়েছে। স্যার, একটাই ছেলে আমার। ওরা চকোলেট কারখানায় চাকরি দেবে বলেছিল। যদি জানতাম রাশিয়ায় যুদ্ধে ঠেলে দেবে, কখনোই ছেলেটারে পাঠাতাম না। আমার কলিজার টুকরা ছেলেকে যেকোনো মূল্যে ফেরত চাই। সরকারের কাছে আবেদন করি, যেন এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।’
তিনি জানান, স্থানীয় দালাল মনজুরুল হোসেন প্রথমে আরমানকে রোমানিয়ায় পাঠানোর প্রসস্তাব দেয়। দালাল বারবার ফুসলাতে থাকে। বিশেষ করে রাশিয়ায় ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে বলে জানালে তাঁরা রাজি হন। বেতনও ধরার কথা দুই লাখ টাকা। প্রায় সাড়ে তিন মাস কেটে গেছে। এখন গোটা পরিবারে নেমে এসেছে দুশ্চিন্তার মেঘ।
ড্রিম হোম ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা হয় ড্রিম হোম ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান এম এম আবুল হাসানের সঙ্গে। অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেন, মালি বা বাবুর্চির ভিসাতেই ১০ জনকে রাশিয়া পাঠিয়েছিলেন তিনি। তবে তাদের যুদ্ধের মাঠে ঠেলে দেওয়া হবে—এ বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না।
যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু সেনা ক্যাম্পে চাকরি, তাই আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এখানে আমাদের কোনো দায় নেই। এখন আমরা তাদের ফেরত আনতে চেষ্টা করছি।’ দোহারের নবাবগঞ্জের বাসিন্দা শফিকুল ইসলামের মাধ্যমে এই তরুণদের রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল বলে জানান তিনি।
স্থানীয় দালাল মনজুরুল হোসেনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানান, আরমান তাঁর নিকটাত্মীয়। তিনি নিয়মিত ওই এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠান। ভালো সুযোগ থাকায় আরমানকে রাশিয়ায় পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হবে, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি নিজেও এজেন্সি কর্তৃক মারাত্মক প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন।