Hot

রাষ্ট্রদূত পদ পাচ্ছেন ‘আড়াই ঘণ্টার এমপি’, রাজনৈতিক বিবেচনায় একজন শিক্ষকনেতাকে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার

রাজনৈতিক বিবেচনায় একজন শিক্ষকনেতাকে রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দায়িত্বশীল একাধিক সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ‘আড়াই ঘণ্টার এমপি’ খ্যাত শিক্ষকনেতা শাহজাহান আলম সাজুকে বাহরাইনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মানামা গ্রহণ করলে ৩ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাবেন তিনি। স্মরণ করা যায়, দীর্ঘদিন ধরে মানামায় রাষ্ট্রদূতের পদটি শূন্য। পরিচালক পদমর্যাদার (পররাষ্ট্র ক্যাডার, ৩০তম ব্যাচ) একজন কূটনীতিক চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে ৯ মাস ধরে রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন। ক’মাস আগে বাহরাইনে একজন পেশাদার কূটনীতিককে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু প্রস্তাবিত দূতকে গ্রহণ করেনি মানামা। ফলে পূর্বের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয় ঢাকা। ফলশ্রুতিতে শাহজাহান সাজুকে পাঠানোর নতুন ওই সিদ্ধান্ত!

কে এই সাজু, আড়াই ঘণ্টার জন্য তিনি এমপি হন যেভাবে?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার বৈকণ্ঠপুর (বড়তল্লা) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৬৭ সালে জন্ম সাজু’র। তার পিতা সামসুল হক ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন সরকারি চাকুরে।

সাজু’র শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি এবং মাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা আশুগঞ্জে হলেও পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। গাজীপুর থেকে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজ জীবন থেকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। আশুগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠা করেন কারিগরি ও বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয় এবং নিজেই অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এক সময়কার ছাত্রনেতা সাজু হয়ে ওঠেন শিক্ষকনেতা। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদকই তার মুখ্য পরিচয়। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করলে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাজু’কে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব করা হয়। দফায় দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে প্রায় ১৫ বছর ধরে তাকে একই পদে রাখা হয়েছে। বিএনপিত্যাগী প্রবীণ সংসদ সদস্য উকিল আব্দুস সাত্তারের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে গত বছরের শেষার্ধ্বে শূন্য হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসন। ১৫ই নভেম্বর ওই আসনে উপনির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে নৌকা তথা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন ড. শাহজাহান আলম সাজু। পাঁচ দশক আগে ওই আসন থেকে হারিয়ে যাওয়া নৌকা পুনরুদ্ধার করেন তিনি। যদিও সেই নির্বাচনে তীর্থের কাকের মতো ভোটারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন ভোটগ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আশুগঞ্জের বিভিন্ন কেন্দ্রের ভোটাভুটির চিত্র সেদিন ভাইরাল হয়েছিল। যাক, নির্ধারিত সময়ে এমপি হিসেবে শপথ নেন বিজয়ী শাহজাহান সাজু। একাদশ সংসদে সর্বশেষ অন্তর্ভুক্ত সদস্য হিসেবে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী তার শপথবাক্য পাঠ করান। কিন্তু ততক্ষণে ওই সংসদের কার্যক্রম প্রায় শেষ!

শপথ অনুষ্ঠানের আড়াই ঘণ্টার মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার রিজার্ভেশন সত্ত্বেও আগারগাঁওয়ের সেই হুইসেলে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ডামাডোল বাজতে শুরু করে। দ্বাদশ সংসদের ওই নির্বাচনে শাহজাহান আলম সাজুকে ফের মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নিজেকে ‘আড়াই ঘণ্টার এমপি’ হিসেবে উপস্থাপন করে তিনি ভোটের মাঠে নামেন। মুহূর্তেই মেঘনা বিধৌত আশুগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ নেন পরিচিত মুখ সাজু। কিন্তু না, সেই ভোটে তিনি টিকতে পারেননি। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সব সমালোচনা অগ্রাহ্য করে নজিরবিহীনভাবে বিরোধী জাতীয় পার্টির সঙ্গে নীরবে আসন সমঝোতা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই ঘটনার বলি হন নৌকার প্রার্থী সাজু। দলীয় সিদ্ধান্ত তথা হাইকমান্ডের নির্দেশে সেদিন  বিনাবাক্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য হন তিনি। 

জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন এবং ভোটারের কাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মাঠে খাটেন কৌশলী ছাত্রনেতা থেকে ক্রমে শিক্ষকনেতা হয়ে ওঠা শাহজাহান সাজু। যদিও ৭ই জানুয়ারির আলোচিত সেই নির্বাচনে আশুগঞ্জ আসনে জাপা’র প্রার্থীর ভরাডুবি শেষ পর্যন্ত ঠেকানো যায়নি। এমপি হলেও জাতীয় সংসদে অধিবেশনে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকা শাহজাহান সাজুর ঘনিষ্ঠরা বলছেন-  ভোটের মাঠ থেকে মাঝপথে সরে দাঁড়ানোর (মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার) বিষয়টি ছিল তার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক। কিন্তু তিনি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন কোনোরকম উচ্চবাচ্য ছাড়াই। তাছাড়া ছাত্র জীবন থেকে দলের জন্য তার ত্যাগও রয়েছে। সব মিলিয়ে ‘পুরস্কার’ হিসেবে হয়তো রাষ্ট্রদূত পদে তার এই মনোনয়ন! সেগুনবাগিচা বলছে, রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে বাহরাইন ছাড়াও বাংলাদেশের আরও ৮টি বৈদেশিক মিশনে পরিবর্তন আসছে। নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদেশে মিশন প্রধান পদে বৃহৎ আকারে এটি হবে দ্বিতীয় রদবদল।

জেনেভাসহ অন্য ৮ মিশনে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন?
জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ড. হাছান মাহমুদের দায়িত্ব গ্রহণের ৩ মাসের মাথায় কানাডা, ইতালি, গ্রিস, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও কুয়েতে নতুন রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। মিশনপ্রধান পদে পরিবর্তনের প্রথম লটে ৭টি ফাইল উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু তখন ৬টি ফাইলে অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বহুপক্ষীয় কূটনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি পদে পেশাদার এক কূটনীতিকের মনোনয়ন সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদন না হয়ে ফেরত আসে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এবারে জেনেভাস্থ জাতিসংঘ মিশন এবং রাষ্ট্র হিসেবে সুইজারল্যান্ডে নতুন রাষ্ট্রদূতের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারপ্রধান জেনেভাসহ এবারে উত্থাপিত সব ফাইলই অনুমোদন করেছেন। ফলে জেনেভা, কলম্বো, কেপটাউন, আম্মান, দ্য হেগ, নাইরোবি, বন্দর সেরি বেগাওয়ান এবং ইসলামাবাদ মিশনের জন্য মনোনীত দূতদের গ্রহণে অনাপত্তিপত্র (এগ্রিমো) চেয়েছে সেগুনবাগিচা। শ্রীলঙ্কায় ৩ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তারেক মো. আরিফুল ইসলামকে জেনেভাস্থ জাতিসংঘ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি কাম সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। 

কলম্বোতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমানে কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের উপ-হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস। পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা আন্দালিবের রাষ্ট্রদূত হিসেবে এটি হবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। ৩ বছরের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত নূর-ই হেলাল সাইফুর রহমানকে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দেশ জর্ডানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জর্ডানে ৩ বছর ধরে দায়িত্বরত রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান বাংলাদেশের পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে অটোয়ায় দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পূর্ব ইউরোপ ও সিআইএস অনুবিভাগের প্রধান হিসেবে (মহাপরিচালক) দায়িত্বরত শাহ আহমেদ শাফিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। ১৭ ব্যাচের ওই কর্মকর্তার রাষ্ট্রদূত হিসেবে এটাই হবে প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। 

নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহর ঢাকায় বদলির আদেশ হয়েছে। দ্য হেগে পরবর্তী রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হচ্ছে বর্তমানে কেনিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারেক মোহাম্মদকে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গবেষণা অনুবিভাগের মহাপরিচালক নওরীন আহসানকে ব্রুনাই দারুস সালামে বাংলাদেশের পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। বন্দর সেরি বেগাওয়ানে ৩ বছর ধরে দায়িত্বরত নাহিদা রহমান সুমনা গ্রিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। সক্রেটিসের দেশে দীর্ঘ সময় সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমদের অবসরোত্তর ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে মিশনপ্রধানের পদটি শূন্য রয়েছে। 

বর্তমানে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মহাপরিচালক (অপারেশনস) মো. ইকবাল হোসাইন খান এনডিসিকে বাংলাদেশের পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে পাকিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইসলামাবাদে বাংলাদেশের বর্তমান হাইকমিশনার রুহুল আলম সিদ্দিকীকে ঢাকায় ফিরতে বলা হয়েছে। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শহর মুম্বইয়ে বাংলাদেশের বর্তমান উপ-হাইকমিশনার চিরঞ্জীব সরকারকে কেনিয়াতে বাংলাদেশের পরবর্তী হাইকমিশনার হিসেবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নাইরোবি ছাড়ার প্রস্তুতিতে থাকা রাষ্ট্রদূত তারেক মোহাম্মদের স্থলাভিষিক্ত হবেন তিনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button