‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংবিধান বিরোধী নয়: হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ চ্যালেঞ্জ করে ৩৭ বছর আগে দায়ের করা রিট আবেদন সরাসরি খারিজের রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেয়া সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও আঘাত করে না।
বিচারপতি নাইমা হায়দারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বৃহত্তর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছেন। বেঞ্চের অপর দুই বিচারপতি হলেন কাজী রেজা-উল হক ও মো: আশরাফুল কামাল।
প্রকাশিত রায়ে রিটটি খারিজের সিদ্ধান্তের সাথে তিন বিচারপতি একমত পোষণ করেছেন। তবে, রায়ে পৃথক পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো: আশরাফুল কামাল।
বিচারপতি নাইমা হায়দারের লেখা পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম শুধু সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত শুধু মৌলিক নীতিগুলো অন্য কোনো বিধানের সাথেও অসংগতিপূর্ণ নয়। সংবিধানে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম মর্যাদা’ প্রদান করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। অনুচ্ছেদ ২ক অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পড়তে হবে এবং পড়লে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ধারণার সন্নিবেশ কোনোভাবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে না। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে না এবং সংবিধানে বাহুল্যতাও সৃষ্টি করে না।
রায়ে বলা হয়েছে, তর্কিত সংশোধনী সংবিধানে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকেও প্রভাবিত করে না। অতএব, আমরা মনে করি যে, তর্কিত সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২ক সন্নিবেশ করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সংবিধানবিরোধী নয়। বিষয়টিকে সহজ করার প্রয়াস হিসেবে, উপস্থাপিত যুক্তিতর্ক আমরা আমাদের রায়ে আলোচনা করেছি।
রিট আবেদনকারী এবং বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের সুনির্দিষ্ট আইনগত যুক্তিগুলো আমরা রায়ে প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছি। কারণ সাংবিধানিক বিষয়‘সামগ্রিকভাবে’ আলোচনা করা উচিত। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে রুল খারিজ করা হলো। রায়ে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধর্মকে যে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেয়া হয়েছে, সেই বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। রায়ের এ পর্যবেক্ষণের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন বিচারপতি কাজী রেজাউল হক।
পৃথক পর্যবেক্ষণে বিচারপতি মো: আশরাফুল কামাল বলেছেন, পঞ্চম সংশোধনীর মতই সপ্তম সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক শাসন বৈধ করা এবং সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠাকারীকে বাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে রক্ষা করা। এই সংশোধনীতে দেশ অথবা জনগোষ্ঠীর স্বার্থ কোথায়?
২০১৬ সালের ২৮ মার্চ রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদন সরাসরি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, এই রিটে আবেদনকারীর আবেদনের এখতিয়ার (লোকাস স্ট্যান্ডি) নেই।
বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো: আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ এ রায় দেন।
১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সংযুক্ত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সংবিধানে ২ (ক) অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে।
তখন স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে ওই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন। তারা হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি কে এম সোবহান, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত, লেখক বদরুদ্দীন উমর, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
রিট আবেদনের ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল দেন। ওই দিনই অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের সহায়তাকারী) হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেন ড. এম জহির, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও আ ফ ম মেজবাহ উদ্দিন।
ওই রুল জারির প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালের ৮ মার্চ এই রুল শুনানির জন্য আদালতে ওঠে। ওই দিন অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগের আদেশটি প্রত্যাহার করেন আদালত। পরে ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ রিটটি সরাসরি খারিজ করে দেয়া হয়।