Bangladesh

রাষ্ট্রীয় পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার, বেনজীরের দায় নেবে কে?

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ‘পাসপোর্ট’ কেলেঙ্কারির দায় নিতে রাজি নয় কেউ-ই। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাতে মরিয়া। কেউ আবার বেনজীরের ক্ষমতার কাছে পরাজিত হওয়ার দাবি করেছেন।

সংশ্লিষ্টদের দাবি-প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে বেনজীরকে প্রাইভেট পাসপোর্ট দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট অধিদপ্তর রুটিন দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র। 

মঙ্গলবার দিনভর দুদক কার্যালয়ে পাসপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য উঠে আসে।

মঙ্গলবার এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব দেননি। এমনকি এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহও সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান।

প্রসঙ্গত, গত ৩ জুন ‘পাসপোর্ট করতে বেনজীরের নজিরবিহীন জালিয়াতি; মিথ্যা পরিচয়ে বিশ্বভ্রমণ’ শিরোনামে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হলে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। পরে ঘটনার তদন্তে নামে দুদক। বেনজীরের পাসপোর্ট দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জড়িতদের তালিকা চেয়ে ১৯ জুন পাসপোর্ট অধিদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়। 

জানা গেছে, দুদকের চিঠির সূত্র ধরে বেনজীরের পাসপোর্ট আবেদন যাচাই-বাছাই শুরু করে পাসপোর্ট অধিদপ্তর (ডিআইপি)। কেন্দ্রীয় সার্ভার থেকে তার আবেদনসহ সংযুক্ত ডকুমেন্ট ডাউনলোড করা হয়। এ সময় আবেদন গ্রহণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট ডেলিভারি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরদের তালিকা করা হয়ছে। এ প্রক্রিয়ায় মোট ২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার তথ্য নিশ্চিত হয়েছে ডিআইপি।

আরও জানা গেছে, দায়দায়িত্ব অনুযায়ী যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বেনজীরের পাসপোর্ট প্রদান প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন তারা হলেন-সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চাকরিচ্যুত) এটিএম আবু আসাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ফজলুল হক, সাবেক পরিচালক (চাকরিচ্যুত) মুনষি মুঈদ ইকরাম, আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক, উপপরিচালক আবু নাইম মাসুম, উচ্চমান সহকারী আজিজুল হক, সাইদুর রহমান, মওদুদুর রহমান, কম্পিউটার অপারেটর সাহেনা হক, মাহবুব আলম, মোহাম্মদ মোহসিন ইসলাম, নূর উদ্দিন, সুবাশ চন্দ্র রায়, রাজ্জাক ও রুকন। এদের মধ্যে ৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মঙ্গলবার সকালে সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে হাজির হন।

দুদক সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে কর্মকর্তারা একেকজন একেক ধরনের তথ্য দিয়েছেন। তবে কেউই নিজেদের দায় স্বীকার করেননি। একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়েছেন। এক কর্মকর্তা দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে জানান, বেনজীর আহমেদ ২০১০ সালে তার হাতে লেখা পাসপোর্ট জমা দিয়ে মেশিন রিডেবল (এমআরপি) পাসপোর্ট নেন। এ সময় তিনি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু তার আবেদন ফরমে পেশা লেখা হয় ‘প্রাইভেট সার্ভিস’। পরে বিভিন্ন সময় পাসপোর্ট নবায়ন করলেও তিনি পেশা সংশোধন করেননি। সর্বশেষ ২০২০ সালে তিনি ই-পাসপোর্ট নেন। তখন আইজিপি হিসাবে তার লাল পাসপোর্ট পাওয়ার কথা থাকলেও সাধারণ কোটায় সবুজ রংয়ের পাসপোর্ট নেন।

জিজ্ঞাসাবাদে দুদক জানতে পেরেছে, বেনজীর আহমেদ সর্বশেষ ২০২০ সালে জুন মাসে ই-পাসপোর্ট হাতে পান (নম্বর বি০০০০২০৯৫)। তখন প্রচলিত সব নিয়ম পাশ কাটিয়ে অসুস্থতার অজুহাতে পাসপোর্টের বিশেষ কারিগরি টিমকে বাসায় ডেকে নেন। এরপর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অতি গোপনে সব কাজ সম্পন্ন হয়। পাসপোার্ট প্রিন্টিং শেষে এএসপি (সহকারী পুলিশ সুপার) মোহাম্মদ আনোয়ার সিকদার বেনজীরের প্রতিনিধি হিসাবে তা গ্রহণ করেন।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে এক কর্মকর্তা বলেন, বেনজীর ক্ষমতাধর এবং প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময় তার ভয়ে অনেকেই তটস্থ থাকতেন। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বেনজীরের পাসপোর্ট আবেদন যাচাই করা সম্ভব হয়নি। আবেদন যেভাবে এসেছে সেভাবেই তাকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১৬ সালে একবার তাকে প্রাইভেট সার্ভিস পরিচয়ের জন্য এনওসি দাখিল করতে বলা হয়। তখন র্যাব সদর দপ্তর থেকে পাঠানো চিঠিতে প্রাইভেট সার্ভিস পরিচয়েই বেনজীরের পাসপোর্ট নবায়ন করতে বলা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ই-পাসপোর্টের আবেদন অনলাইনে জমা দিলেও নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা তা গ্রহণ করেন। এরপর আরও কয়েকটি ধাপে যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত প্রিন্টিং সম্পন্ন হয়। শেষ ধাপে ডেলিভারির আগে আরেক দফা যাচাইয়ের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বেনজীরের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই করা হয়নি। অনলাইনে ফরম জমার পর সব কাজ সম্পন্ন হয় অস্বাভাবিক দ্রুততায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বেনজীরের ব্যক্তিগত তথ্য গ্রহণ থেকে শুরু করে অন্য কাজগুলো সম্পন্ন করেন সাহেনা হক নামের এক কম্পিউটার অপারেটর। কিন্তু তিনি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল ছিলেন না। ই-পাসপোর্ট বাস্তবায়নকারী জার্মান কোম্পানি ভেরিডোজের কর্মী ছিলেন সাহেনা। কয়েক বছর আগে তিনি স্থায়ীভাবে জার্মানি চলে যান। বিদেশে থাকায় তিনি দুদকের ডাকে হাজির হননি। এছাড়া বেশ কয়েকজন অবসরে গেছেন। কয়েকজন দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচ্যুত।

পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বেনজীরের পাসপোর্ট কেলেঙ্কারির দায় একা পাসপোর্ট অধিদপ্তরের নয়। এক্ষেত্রে যথাযথ পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয়নি। তিনি সাধারণ পাসপোর্ট দেখিয়ে নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ করেছেন কিন্তু পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যরা এ বিষয়ে কোনো রিপোর্ট দাখিল করেননি। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও বিষয়টি একেবারেই টের পায়নি এমন ভাবার সুযোগ নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button