International

রুশ বাহিনী এগোচ্ছে, ইউক্রেনীয় সেনারা পর্যদুস্ত— কিয়েভের জন্য নাজুক হচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতি

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) এর ইউরোপ, রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ম্যাক্স বার্গমান গত মাসে লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে রাশিয়ার পক্ষে। তাই অস্ত্র ও জনবল শক্তির সুবিধাকে অব্যাহতভাবে কাজে লাগাচ্ছে দেশটি। এই মুহূর্তে রাশিয়ার শান্তি আলোচনায় বসবার তেমন যৌক্তিকতা নেই, কারণ তিনি (পুতিন) সম্ভবত মনে করছেন যে– এই যুদ্ধ জিততে পারবেন। তাঁর দৃষ্টিতে সেই বিজয় হচ্ছে, ইউক্রেনকে রাশিয়ার অধীনস্ত করা।’

ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে, চাপে ফেলে এবং প্রায় পরাভূত করে— পূর্ব ইউক্রেনে সামনে বাড়ছে রুশ সেনাবাহিনী। আরও জনবল, অস্ত্রবল ও সামগ্রিক গতির সুবাদে এই রণাঙ্গনের শীতে জমাট বাঁধা প্রান্তর এবং কাদাময় পরিখা পার করে তাঁরা এগিয়ে চলেছে।

পোকরভস্ক, যার যুদ্ধপূর্ব জনসংখ্যা ছিল ৬০ হাজার, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি, যেখানে রুশ বাহিনীর অবিরাম আক্রমণের মুখে প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এটি একমাত্র স্থান নয়— যেখানে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে শান্তি আলোচনার জন্য চাপ বাড়লেও— ক্রেমলিন বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষ থেকে অনমনীয় মনোভাবই প্রকাশ পাচ্ছে। ইউক্রেন বা তার পশ্চিমা মিত্রদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে— যুদ্ধবিরতির এমন কোনো শর্তের কথা মস্কো থেকে কেউ বলছে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) এর ইউরোপ, রাশিয়া ও ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক ম্যাক্স বার্গমান গত মাসে লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে রাশিয়ার পক্ষে। তাই অস্ত্র ও জনবল শক্তির সুবিধাকে অব্যাহতভাবে কাজে লাগাচ্ছে দেশটি। এই মুহূর্তে রাশিয়ার শান্তি আলোচনায় বসবার তেমন যৌক্তিকতা নেই, কারণ তিনি (পুতিন) সম্ভবত মনে করছেন যে– এই যুদ্ধ জিততে পারবেন। তাঁর দৃষ্টিতে সেই বিজয় হচ্ছে, ইউক্রেনকে রাশিয়ার অধীনস্ত করা।’

এমন প্রেক্ষাপটে, নতুন বছরে ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রের বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো—

পোকরভস্ক

অতীতে যখন যুদ্ধের আঁচ লাগেনি— তখন কয়লা খনি, কোক (কয়লা থেকে উৎপাদিত এক প্রকার জ্বালানি) কারখানা ও বিভিন্ন ধাতব শিল্প শহর হিসেবে পরিচিত ছিল ইউক্রেনের দনেৎস্ক ওব্লাস্টের পশ্চিমপ্রান্তের এই শহর। শিল্পের সুবিধার্থে পোকরভস্কে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে জংশন। যেটি এই অঞ্চলের প্রধান কয়েকটি রেলপথের কেন্দ্রে অবস্থিত।

শান্ত সেই অতীত আজ যেন দূরঅস্ত স্মৃতিতে। যুদ্ধের ময়দানে রুশ বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য পোকরভস্কের দখল নেওয়া। কারণ, তাতে সেনা ও রসদ পরিবহনের সুবিধা যেমন তারা পাবে, তেমনি ইউক্রেনীয় বাহিনীকে একই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা যাবে। ফলে যুদ্ধরত দুই পক্ষের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। অন্তত কৌশলগত দিক দিয়ে তো বটেই।

গত বছরের শুরুর দিকে আভদিভকা দখলের পর রুশ সেনাবাহিনী পশ্চিম ও উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে ইউক্রেনীয় রসদ সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করতে। পশ্চিমদিকে চলে যাওয়া– ই৫০ নামের মহাসড়ক পোকরভস্কের সাথে তুলনামূলক বড় নগর দনিপ্রোর সড়কপথে সংযোগ স্থাপন করেছে। দনিপ্রো ইউক্রেনের চতুর্থ বৃহৎ শহর। আবার উত্তর ও উত্তরপূর্বে চলে যাওয়া টি-০৫০৪ মহাসড়ক কোস্তান্তিনিভকার সাথে পোকরভস্কের সড়ক সংযোগ তৈরি করেছে। কোস্তান্তিনিভকা-ও আরেকটি প্রধান রেলওয়ে জংশন, যা দখলে নিতে চায় রুশ সেনারা।

ইউক্রেনের সাবেক একজন রিজার্ভ সেনা কর্মকর্তার পরিচালিত একটি বিশ্লেষক সংস্থা– ফ্রন্টেলিজেন্স ইনসাইট যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘পোকরভস্কের দিকটি যুদ্ধের অন্যতম তীব্র ও বিরোধপূর্ণ এলাকা হিসেবে রয়েছে। শহরটি সরাসরি দখলে নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর রুশ বাহিনী ‘ফ্ল্যাংকিং ম্যানুভার’ নামে পরিচিত একটি কৌশল গ্রহণ করেছে। এই কৌশলটি শত্রুর সম্মুখভাগের প্রতিরক্ষাকে পাশ কাটাতে— তাদের পেছন থেকে আক্রমণ করতে ব্যবহৃত হয়।

ইউক্রেন সেনাবাহিনীর খোর্তিসিয়া কম্যান্ড গ্রুপের একজন মুখপাত্র ভিক্টর ত্রেহুবভ গত ২ জানুয়ারি রাষ্ট্রায়ত্ত একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে বলেন, শত্রুরা এখন পোকরভস্কে লড়াই করতে চায় না, এজন্য শহরটিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে, পেছনদিকে থাকা আমাদের সরবরাহ লাইনকে তছনছ করে দিতে চায়।’

মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল লিয়াম কলিন্স মনে করেন, শান্তি আলোচনার আগেই আরও ভূখণ্ড দখলের তাড়ায় আছে রাশিয়া। এজন্য রুশ বাহিনী পোকরভস্ককে পাশ কাটানোর চেষ্টা করতে পারে। পোকরভস্ক— দনেৎস্ক ও দনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলের আঞ্চলিক সীমান্ত থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

তিনি আরও বলেন, খুব সম্ভবত তাঁরা (রুশ সেনারা) রক্তক্ষয়ী শহুরে লড়াই এড়াতে চায়; এর আগে বাখমুতের দখল নিতে তাঁদের টানা কয়েক মাস ধরে এ রকম লড়াই করতে হয়েছিল।

‘রুশ সেনাবাহিনী, বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের সেনাবাহিনীর মতো—শহরটিকে পাশ কাটিয়ে এগোতেই চাইবে, যাতে শহরের ভেতরে থাকা ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের রসদ সরবরাহের পথ বন্ধ করে দিতে পারে। এরপর রুশ সেনারা অপেক্ষা করবে। কারণ রসদের অভাবে এক পর্যায়ে শহরের ভেতরে থাকা যোদ্ধাদের বাইরে এসে আত্মসমর্পণ করতে হবে’—যোগ করেন কলিন্স। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং আরবান ওয়ারফেয়ার’ নামের একটি বইয়েরও লেখক তিনি।

কুরাখোভ

পোকরোভস্ক থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কুরাখোভ। এখানে ভোভচা নদীতে বাঁধ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি জলাধার। এর আগে রুশ বাহিনীর অগ্রযাত্রাকে ধীর করতে এই জলাধারের পানি ব্যবহার করতে চেয়েছিল ইউক্রেনীয়রা। কিন্তু, মতলব ধরতে পেরে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে বাঁধের উত্তরদিক দিয়ে অগ্রসর হয় রুশ বাহিনী। এ সময় জলাধারের পশ্চিমমুখের একটি বাঁধ আংশিকভাবে ধ্বংস হয়—তবে এই কাজ রুশ সেনাদের নাকি ইউক্রেনীয়দের, তা স্পষ্ট নয়।

জলাধারের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত কুরাখোভ শহর। পূর্ব দিক থেকেও রুশ সেনারা অগ্রসর হলে এই শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় ইউক্রেনীয় বাহিনী। বর্তমানে কেবল পশ্চিমদিকের শিল্প এলাকা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে আছে।

কুরাখোভের পশ্চিমে চলে যাওয়া দনেৎস্ক-ঝাপোরিঝিয়া মহাসড়ক (ইউক্রেনের) আরেকটি প্রধান রসদ সরবরাহ পথ। দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে এই পথটিও বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করেছে রুশ বাহিনী।

মাঠপর্যায়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখতে প্রায়ই ইউক্রেন সফর করেন পোলিশ সামরিক বিশেষজ্ঞ কনরাড মুজিকা। তিনি বলছেন, জনবলের (সেনাসংখ্যায়) ঘাটতি পূরণে ইউক্রেন দীর্ঘদিন ধরে সমস্যার মধ্যে আছে। কুরাখোভের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে এই ঘাটতি আরও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।

‘জলপথ থাকায় এই অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ করা সহজ, কিন্তু জনবলের ঘাটতির কারণে রুশ বাহিনীকে থামাতে প্রাকৃতিক এসব বাধা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না ইউক্রেনীয়রা। জনবলের এই ঘাটতির কারণে তাঁরা পাল্টা আক্রমণেও যেতে পারছেন না, যা করতে পারলে এই এলাকায় রাশিয়ার অগ্রগতিকে ব্যাহত করা যেত।’

কিয়েভের একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ মিখাইলো ঝিরোখোভ বলেন, কুরাখোভের প্রতিরোধ আসলে ধ্বংসের মুখে; বর্তমানে শুধু রাজনৈতিক কারণে এটি রক্ষা করা হচ্ছে। কারণ এই শহরের পতন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে রাজনৈতিকভাবে সমস্যার মধ্যে ফেলবে। তাঁর জনসমর্থনকে আরও তলানিতে নিয়ে যাবে।

মোকরি ইয়ালি উপত্যকা

কুরাখোভ থেকে পশ্চিমে মোকরি ইয়ালি নদী বয়ে গেছে দক্ষিণমুখে। নদীর দুই তীরেই রয়েছে বেশ কিছু গ্রাম এবং ছোট ছোট সেতু। নদীতীরের এমন একটি গ্রাম হলো ভেলিকা নভোসিলকা।

ইউক্রেনীয় বাহিনীর ২০২৩ সালের পাল্টা আক্রমণ অভিযান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। এ সময় মোকরি ইয়ালি উপত্যকার বেশ কিছু স্থানে রুশ সেনাদের প্রতিরোধ ভেদ করতে পেরেছিল ইউক্রেনীয় সেনারা। তাঁরা ভেলিকা নভোসিলকা গ্রামের কাছাকাছিও চলে আসেন। কিন্তু, এখানে রুশ সেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা, পরিখা, ভূমিমাইনের বিস্তৃত জাল এক দুর্ভেদ্য গড়ে তোলে, যার সামনে আর সামনে এগোতে পারেননি ইউক্রেনীয়রা। তাঁদের সার্বিক আক্রমণ অভিযানের মতো এটিও মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে আবারও এই গ্রামের পূর্বদিকে এগিয়ে এসেছে রুশ বাহিনী। নদীর উজানের দিকে অবশ্য কিছুটা সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এখানে তাঁরা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নোভি কোমার গ্রামের দখল নিয়েছেন। এই গ্রামের মধ্য দিয়েই চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক, যা ভেলিকা নভোসিলকা গ্রামের পারাপারের সেতুটির সাথে সংযুক্ত। অর্থাৎ, যদি ইউক্রেনীয়রা এক্ষেত্রে ব্যর্থ হতেন, তাহলে নদী পার হয়ে পশ্চিম তীরে চলে আসত রুশরা।

তবে এই উপত্যকার গ্রামগুলো নিয়ে লড়াই এখনো চলমান। ওই সড়কটি লক্ষ্য করে কামানের গোলা ও ড্রোন হামলা করছে রুশ সেনারা। যার কারণে এখানে থাকা সেনাদের রসদ পাঠানোর সামর্থ্য অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে ইউক্রেনের।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d