Bangladesh

রূপের ফাঁদে সর্বনাশ

♦ চটকদার বিজ্ঞাপনে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি প্রসাধনী ♦ বিক্রি হচ্ছে বিএসটিআইর নিষিদ্ধ ক্রিম ♦ ব্যবহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

‘আজ রাত ১০টায় লাইভে আসছি। থাইল্যান্ড থেকে রং ফরসাকারী ক্রিম এনেছি। সাত দিন মাখলেই গায়ের রং দুধের মতো ফরসা হয়ে যাবে’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রায়ই বিভিন্ন পেজে বিভিন্ন বয়সি নারী উদ্যোক্তারা ছোট ছোট ভিডিওতে ত্বকের রং ফরসাকারী প্রসাধনীর প্রচারণা চালান। আর এসব ভিডিও লাইভ শুরু হলেই হাজার হাজার মানুষ তা দেখেন। এদের অনেকেই রং ফরসা করার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে এসব নকল, ভেজাল ও নিষিদ্ধ ক্রিম কেনেন। কিন্তু এর মাধ্যমে ক্রেতারা যে অজান্তে নিজের শরীরের ক্ষতি করছেন তা ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনের ভেজাল এসব পণ্য কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। তাদের মতে, সারা পৃথিবীতে কোথাও রং ফরসাকারী ক্রিম ব্যবহার করে স্থায়ীভাবে ফরসা হওয়ার উদাহরণ নেই। অথচ বেনামি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়াই তাদের পণ্য ব্যবহারের পর অনেক ভালো ফলাফল পাওয়ার দাবি করে পণ্য বিক্রি করে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই ত্বকের ক্যান্সার ও গর্ভজাত সমস্যায় ভোগেন। জানা গেছে, ভেজাল এসব পণ্যে থাকে মার্কারি ও পারদজাতীয় বিভিন্ন উপাদান থাকে। আর পারদজাতীয় ভারী ধাতু শরীর থেকে বের হতে পারে না। শরীরে দীর্ঘ সময় অবস্থানের ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। পারদ শরীরে ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও হাইড্রোকুইনন ক্রিম (ব্রণের জন্য ব্যবহার হয়) ত্বকের স্বাভাবিক গঠন পরিবর্তন করে। এতে নানা ধরনের সমস্যা থেকে যায়।

রাজধানীর প্রসাধনীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ত্বকের রং ফরসা করার নেশায় ফেসবুকের বিভিন্ন প্রসাধনী পেজ ও শপিং মলে গিয়ে বিভিন্ন বয়সি নারী থানাকা ফেস প্যাকের খোঁজ করেন। মিয়ানমারের তৈরি এ ফেস প্যাকটি যে প্লাস্টিকের কৌটায় বিক্রি হয় সেখানে মিয়ানমারের ভাষা লেখা। যা বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের কাছে দুর্বোধ্য। অভিযোগ আছে বাজারে যে থানাকা বিক্রি হচ্ছে তা ভেজাল। আর এটি ব্যবহারে এক সপ্তাহে ত্বকের রং উজ্জ্বল হওয়ার বিষয়টিও ভিত্তিহীন।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, নামি-বেনামি বিভিন্ন প্রসাধনী বিশেষ করে রং ফরসাকারী ক্রিম ব্যবহারের ফলে ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ ছাড়াও এর ফলে ত্বকের চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, ত্বকে লোমের পরিমাণ বৃদ্ধি, ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হওয়া, লোমের গোড়ায় ফোড়াসহ ত্বকে ভাঁজ পড়ে যায়। আশঙ্কার বিষয় এর ফলে গর্ভবতী নারীর ভ্রƒণটির স্নায়ু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় ফলে জন্ম নেওয়া সন্তানটি মানসিক পঙ্গুত্বের শিকার হয়।

চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রং ফরসাকারী ক্রিম, ব্রণ বা মেছতার ক্রিম মেখে ত্বকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আমাদের কাছে অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। ধারণা করছি ভেজাল এসব প্রসাধনীতে স্টেরয়েডের মতো পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এর ব্যবহারে মুখের ত্বক পাতলা হয়ে যায়, ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক কমে যায়। এর ফলে ত্বকে বিভিন্ন ধরনের ইকফেকশন হয়। এ ধরনের ক্রিমগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারে ত্বকের ক্ষতি হয় এর পাশাপাশি ত্বকের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রসাধনীর দোকানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিদেশি পণ্যে আমদানিকারকের স্টিকার ব্যবহার করা হচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ীরা আসল না নকল পণ্য বিক্রি করছেন তা জানা যাচ্ছে না। বিক্রেতারা বিদেশি পণ্যের নামে যে পণ্য বিক্রি করছেন তার আমদানিকারকের কোনো তথ্য তারা দিতে পারে না। অভিযান পরিচালনা করা হলে তারা জানান, তাদের কাছে এসে একটি সিন্ডিকেট এসব পণ্য দিয়ে যায়। এর মধ্যে অনেকটি আবার মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলোতে বিএসটিআইএর কোনো সিলও নেই। আবার অনলাইনেও এখন বিভিন্ন নাইট ক্রিম, সিরাম, সুদিং জেলসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে। এগুলোর মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। কিন্তু যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভিন্ন পেইজ থেকে বিক্রি হওয়া পণ্যগুলো ভোক্তার ক্ষতি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। তাদের মতে অনলাইনে যারা পণ্য বিক্রি করেন তারা অনেক সময় আমদানিকারক থেকে পণ্য নেন না। এক্ষেত্রে পণ্য ভেজাল হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাজারে বিএসটিআইর অনুমোদনহীন ফেস ক্রিম, রং ফরসাকারী ক্রিমসহ অন্য প্রসাধনী বিক্রি করা হচ্ছে। মুখের ক্রিমে রাসায়সিক পদার্থ হাইড্রোকুইনাইন ব্যবহার করার বিধিনিষেধ থাকলেও অনেক ক্রিমে তা ব্যবহার করা হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে এরই মধ্যে বাজারে ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি শুরু হয়েছে।

ডলার সংকটের কারণে নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর ওপর এখন শুল্কারোপ বেশি। এ সুযোগে ভেজাল প্রসাধনীর ব্যবসায়ীরা ভেজাল পণ্য বাজারজাত করার সুযোগ নিচ্ছেন। তারা ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য নকল করে বাজারে ছাড়ার চেষ্টা করছে।

অনলাইনে দেদার বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ ক্রিম : পারদসহ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকায় পাকিস্তান, ভারত ও চীনের তৈরি ত্বকের রং ফরসাকারী ১৫ ধরনের ক্রিমসহ ১৯টি স্ক্রিন ক্রিম ও লোশন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এগুলো নিষিদ্ধ করে। পরীক্ষায় এসব ক্রিম ও লোশনে ক্ষতিকর পারদ ও হাইড্রোকুইনোন পাওয়া যায়। এগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারে চর্ম রোগসহ বিভিন্ন জটিলতা হতে পারে। এজন্য এসব ক্রিম বিক্রি ও বিতরণ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন শপিং মল ও অনলাইনে এখনো এসব নিষিদ্ধ প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে। ফেসবুকের বেশ কয়েকটি পেজে পাকিস্তানের গৌরী ক্রিম এবং হোয়াইট পার্ল, চীনের ড. রাসেল নাইট ক্রিম এবং ড. ডেভি স্কিন লোশনের বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে এবং কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই এগুলো বিক্রি হচ্ছে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান গতকাল বলেন, নকল প্রসাধনীর বিরুদ্ধে আমরা সবসময় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। যারা প্রসাধনীর ব্যবসা করেন ঈদ মৌসুমকে সামনে রেখে মাসখানেক আগেই তাদের নকল পণ্য বিক্রি না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। রমজানে সারা দেশে আমাদের দ্বিগুণ টিম কাজ করছে। প্রায় ৯০টির মতো অতিরিক্ত টিম গত এক মাস ধরে কাজ করছে। ঢাকাতেও দ্বিগুণ টিম কাজ করছে। এরপরও ফাঁক গলিয়ে কিছু অসাধ্য ব্যবসায়ী নকল পণ্য বিক্রি করবে। আমরা ব্যবহারকারীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি নিজের শরীরের ক্ষতির কথা চিন্তা করে হলেও এ ধরনের ক্ষতিকর পণ্য ব্যবহারে সতর্ক হোন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d