Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
Hot

রেলের মাফিয়া

শুরুটা ২০১১ সালে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতার আশীর্বাদ নিয়ে রেলের নির্মাণ খাতে আবির্ভূূত হন এক টেন্ডার ডন। ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নেন একের পর এক হাজার কোটি টাকার কাজ। এখন পর্যন্ত রেল খাতের অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছে অখ্যাত এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রকল্পের বরাদ্দের একটা বড় অংশ লুটপাট হয়েছে সিন্ডিকেট করে। আর এই অর্থের বিপুল পরিমাণ কমিশন চলে গেছে দেশ-বিদেশের সুবিধাভোগীদের হাতে। রেল প্রকল্পের টেন্ডার ডন খ্যাত সেই কোম্পানির নাম ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির জাল- জালিয়াতির মাধ্যমে রেলের নির্মাণ খাত নিয়ন্ত্রণের বিস্তারিত তথ্য মানবজমিনের হাতে এসেছে। নথিপত্র ঘেঁটে মিলেছে তাদের নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির চিত্র। সময়টা ২০০৯ সাল। খুঁড়িয়ে চলছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ওই সময়ে মাত্র ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট ছোট নির্মাণকাজ করতো প্রতিষ্ঠানটি। তাও টেনেটুনে শেষ করতে হতো। ব্যাংক লোন নিয়ে চলতো প্রকল্পের কাজ। তখন ম্যাক্সের এককভাবে মাত্র ১৬.৭০ কোটি টাকার রেললাইন প্রকল্প নির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিল। তাও কাজের মান ছিল নিম্নস্তরের। পরে আওয়ামী লীগের সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মির্জা আজমের সহায়তায় রাতারাতি বদলে যায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এই দুই নেতার সহায়তায় দরপত্রে ১৫ নম্বরে থেকেও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ রিনিউয়াল রেল প্রকল্পের কাজ পেয়ে যায়। ওই প্রকল্প পেতেও জালিয়াতি করে ম্যাক্স। মাত্র ১৬ কোটি টাকার একটি কাজের সঙ্গে আরও দুটি চলমান প্রকল্প ৫০ ও ৯৬ কোটি টাকার যোগ্যতা একসঙ্গে দেখিয়ে চিনকি প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে মন্ত্রীর লিখিত সুপারিশে প্রকল্পটির কাজও পেয়ে যায়।

মূলত  সেখান থেকেই ম্যাক্সের উত্থান শুরু। তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শেখ হাসিনা সরকারের নির্মাণ খাতের মাফিয়া খ্যাত দুই প্রভাবশালী নেতার সরাসরি হস্তক্ষেপে রেলের একের পর এক বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেতে থাকে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এই দুই নেতার প্রভাব খাটিয়ে রেলের সব প্রকল্প একাই গিলে খেয়েছে  গ্রুপটি। শুধু রেল নয়, গত ১৫ বছরে উন্নয়ন খাতের অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। যা দেশের উন্নয়ন খাতের এক নজিরবিহীন ইতিহাস।

হাসিনা সরকার পতনের পরে এখনো রেল সিন্ডিকেট ধরে রেখেছে রেলের কালো বিড়াল খ্যাত ম্যাক্স গ্রুপ। চিনকি আস্তানার পরে কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ রেল প্রকল্পের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ পায় ম্যাক্স। বর্তমানে রেলের চলমান আরও বড় দুটি প্রকল্পেও কাজ করছে এই গ্রুপটি। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা ক্ষয়প্রাপ্ত রেল প্রকল্প, ২০১১ সালে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার লাকসাম-চিনকি আস্তানা রেল প্রকল্প, ২০১৫ সালে ৬ হাজার কোটি টাকার আখাউড়া লাকসাম রেলপথ প্রকল্প, ২০১৬ সালে ১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ৪ নম্বর গ্রেডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কীভাবে রেলের এতবড় সব প্রকল্প বাগিয়ে নিলো? এত অল্প সময়ে কোন শক্তির জোরে যোগাযোগ খাতে মাফিয়া হলে উঠলো প্রতিষ্ঠানটি? কোন ক্ষমতার বলে একচেটিয়া আধিপত্য করতে পারলো ম্যাক্স। ১৬ কোটি টাকার কাজ পাওয়ার যোগ্য প্রতিষ্ঠান কীভাবে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পেলো তা নিয়ে রেল খাতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তবে দরপত্রে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতা জড়িত থাকায় ম্যাক্সের তেলেসমাতি কাণ্ড নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। মানবজমিন অনুসন্ধানে ম্যাক্স গ্রুপের জাল- জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও এর পেছনে কারা জড়িত তা বেরিয়ে এসেছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিক ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর নিজেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম ডোনার হিসেবে পরিচয় দিতেন। বিভিন্ন সময়ে হাসিনা সরকারের পক্ষে দেশের কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের দেয়া একাধিক বিবৃতিতেও গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর স্বাক্ষর করেছেন। সরকার পতনের পরে দুর্নীতির দায়ে জেলও খেটেছেন। এখনো দুর্নীতির মামলা চলমান আছে। বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে অন্যতম এই আলমগীর। রেলওয়ে ছাড়াও সমপ্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ম্যাক্সের মালিক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজমের বন্ধু। সেই সুবাধে মির্জা আজমের সহায়তায় রেলের সকল প্রকল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতেন ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। দরপত্রে যোগ্যতার মাপকাঠিতে ১০ নম্বরে থেকেও রেলের একের পর এক প্রকল্পের কাজ পেয়েছেন ম্যাক্স লিমিটেড। একপ্রকার প্রতিযোগিতাহীনভাবে রেলের ৯০ শতাংশ প্রকল্পের টেন্ডার পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ। মূলত ৩০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়েই তিনি এই প্রকল্পের কাজ পেতেন বলে রেল সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। এদিকে মির্জা আজমের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র মানবজমিনকে বলেছেন, গত ১৫ বছরে রেলের ৭০ হাজার কোটি টাকার কাজ একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন মির্জা আজম। শেখ রেহানা সিন্ডিকেটের প্রধান হয়ে কাজ করেছে মির্জা আজম। বড় অঙ্কের কমিশন নিয়েই এসব কাজ তাদের দেয়া হয়েছে। মির্জা আজম শুধুমাত্র মিডিয়া ছিল। কিন্তু পুরো টাকা চলে গেছে শেখ রেহানার কাছে। ম্যাক্সের মালিক আলমগীরের সঙ্গেও শেখ রেহানার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। তাই তিনি যে প্রকল্পের কাজ চেয়েছে তাই-ই পেয়েছে। 
যেভাবে প্রতারণা করেছে ম্যাক্স: ঠিকাদারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন আন্তর্জাতিক দরপত্রে জয়েন ভেঞ্চারের শর্ত মোতাবেক শুধু পার্টনার হিসেবে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে হলে ওই প্রকল্পের মোট মূল্যের অন্তত ২৬ শতাংশ মূল্যমানের কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। ম্যাক্সের ২ শতাংশ কাজ করারও অভিজ্ঞতা ছিল না। অনুসন্ধানেও একই তথ্য পাওয়া গেছে, কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী দরপত্র দাখিলের সময় ম্যাক্সের দেয়া অতীত অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে যে আইনগত পরিচয় ও কাজের কথা (লাকসাম-চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প) উল্লেখ করেছে, তা ছিল অস্পষ্ট ও জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ। এজন্য তারা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাতে তারা বিদেশি লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে মাক্স ওই কাজে অংশ নেয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। পরে ওই কাজের পুরো অভিজ্ঞতাকেই নিজের বলে দাবি করে চালিয়ে দিয়েছেন। যা রেল খাতের একটি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ছিল। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজটি মূল প্রকল্প দলিল ডিপিপি ও সংশোধিত প্রকল্প দলিলে আরডিপিপি মোতাবেক একটি একক কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যোগ্যতার মানদণ্ডে অতীত অভিজ্ঞতায় আর্থিক মূল্যমানের সীমারেখা বিবেচনায় ম্যাক্সকে ওই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য এই একক কাজকে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান ও মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। যেটা লট-১ ও লট-২ প্যাকেজ নামে পরিচিত। লট-২ প্যাকেজের কাজ ম্যাক্স লিমিটেড নিয়েছিল একটি চাইনিজ ঠিকাদারের সঙ্গে জয়েন্ট  ভেঞ্চার করে। বিষয়গুলো বোঝার জন্য এই লট-২ তে কাজের অতীত অভিজ্ঞতার কি শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছিল সেটা দেখার জন্য অনুরোধ করেছেন এই ব্যক্তি।
রিকোয়ারমেন্টে যা বলা হয়েছে: এই প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য ঠিকাদারদের অতীত অভিজ্ঞতার স্বপক্ষে বিগত ১০ বছরের মধ্যে কমপক্ষে একটি কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যার মূল্যমান ২৭০ মিলিয়ন ডলার। যা ২২৬৮ কোটি টাকা। এবং ট্র্যাক, ব্রিজ, ইমব্যাংকমেন্ট, স্টেশন বিল্ডিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। যদি প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট ভেঞ্চার করে তাহলে লিড পার্টনারের জন্য কাজের বৈশিষ্ট্য এবং মূল্যমানের ক্ষেত্রে পুরো অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এবং পার্টনারদের ক্ষেত্রেও ওইরূপ অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, তবে সেটা মূল্যমানের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ থাকলেই চলবে। অর্থাৎ ২২০৮ কোটি টাকার ২৫ শতাংশ যা ৫৬৭ কোটি টাকা। ম্যাক্স যে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছে, সে কাজে ম্যাক্সের আইনগত অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা কেমন ছিল? টিএসসি’র মতামতগুলো প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমানের মাধ্যমে টেকনিক্যাল বিড ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট এড়িয়ে গিয়ে কীভাবে প্রভিয়াসলি কমপ্লাইড স্টাটার্সকে কমপ্লাইড করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট এডিবিতে গেলে পরবর্তীতে সেই জবাব হুবহু উল্লেখ করে প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান ম্যাক্সের জবাবকে বৈধতা দিয়ে সুপারিশসহ এডিবি’র কাছে পাঠিয়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ষোলকলা পূর্ণ করে। লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি সম্পাদিত হয় সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনের সঙ্গে। ম্যাক্স এখানে শুধু পার্টনার। কাজের সফল সমাপ্তিতে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্টকে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক অভিজ্ঞতার যে সনদ দেয়া হবে তাতে পার্টনার হিসেবে ম্যাক্সের নামও উল্লেখ থাকবে। ম্যাক্স এই অভিজ্ঞতার ক্রেডিনশিয়ালিটি পাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশন  করার সময় ওই এসোসিয়েশনে তার অন্তর্ভুক্তির পার্সেন্ট হিসেবে। 

পদে পদে ম্যাক্সের জালিয়াতি: ২০১১ সালের ১৭ই অক্টোবর বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনের চুক্তিপত্র সম্পাদিত হওয়ার মাত্র দেড় মাস পর ওই জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনে অঙ্গীভূত তিনটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ স্বাক্ষরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে এই বলে পত্র দেয় যে তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনে যে দু’টি চাইনিজ কোম্পানি আছে লিড পার্টনারের একটি চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট, আরেকটি পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। তারা অনিবার্য কারণবশত এই প্রকল্পের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জনশক্তি, যন্ত্রপাতি ও অর্থ চীন থেকে দ্রুত আনতে পারবে না। তাই তাদের লোকাল পার্টনার ম্যাক্স এই প্রকল্পের ১০০ শতাংশ কাজ একাই সম্পন্ন করবে। কাজ শেষে ১০০ শতাংশ যোগ্যতার সনদ ম্যাক্সই পাবে। পরবর্তীতে জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোসিয়েশনের পার্টনারদের মধ্যে সম্পাদিত বোঝাপড়ায় স্বত প্রণোদিতভাবে ক্ষমতাবান হয়ে সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চারের পক্ষে ম্যাক্স ওই বছর ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর আরেকটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে ম্যাক্স দাবি করেন, তাদের দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে; যাতে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল এই পাঁচ মাস সময় তারা কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু এই সময়ে লিড পার্টনার দুই বিদেশি প্রতিষ্ঠান দ্রুত তাদের সরঞ্জাম আনতে পারবে না। চুক্তির শর্ত অনুসারে চুক্তিকৃত কাজ সম্পাদন ও বাস্তবায়নে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান সবাই যৌথভাবে ও পৃথকভাবে দায়বদ্ধ। তাই অংশীদারদের মধ্যে কেউ যদি তাদের অংশের কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপর অংশীদার তাদের ফেলে রাখা বাকি কাজ শেষ করবে। সেই শর্তানুসারে এটা ম্যাক্সের দায়িত্ব জয়েন্ট ভেঞ্চারের পক্ষে একাই সব কাজ শেষ করা। সিআরএম জয়েন্ট ভেঞ্চারের পক্ষে ম্যাক্স ইতিমধ্যেই ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টি জমা দিয়েছে। চাইনিজ দু’টি প্রতিষ্ঠান লিড পার্টনার চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট এবং পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন সম্মত আছে, যে ম্যাক্স তার নিজস্ব যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম দ্বারা ১০০ শতাংশ কাজ শেষ করবে। এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। এ রকম একটা অনৈতিক, অযৌক্তিক, ক্রয় চুক্তি বহির্ভূত, ক্রয় আইন পরিপন্থি এবং সর্বোপরি একটা খোঁড়া প্রেক্ষাপট তৈরির পর ম্যাক্স বলেন এ অবস্থায় এত বড় একটা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংক থেকে তাদের বড় অঙ্কের লোন গ্রহণ করা প্রয়োজন।

ব্যাংক বলছে, তারা ম্যাক্সকে লোন দেবে যদি ক্রয়কারী বাংলাদেশ রেলওয়ে ম্যাক্সকে ১০০ শতাংশ কাজ করার অনুমতি দেয়। পরে ওই প্রকল্পের পুরো কাজ একাই শেষের অনুমতি চান। ম্যাক্স দাবি করেন, কাজ শেষের পর বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে ম্যাক্সের নামে ১০০ শতাংশ প্রতিযোগিতা সনদ ইস্যু করতে হবে। এটাই হলো ম্যাক্সের সবচেয়ে বড় চাওয়া ও কৌশল। এর মাধ্যমে ১৬.৭ কোটি টাকার কাজে অভিজ্ঞ ঠিকাদার ম্যাক্স লিমিটেড ১৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প কাজ পাওয়ার যোগ্য হয়ে যায়। যেটা পরবর্তীতে ১৮ হাজার কোটি টাকায় কক্সবাজার প্রকল্পের কাজ পেতে সহায়তা করে। প্রশ্ন হলো দু’টি চীনা কোম্পানির সঙ্গে ম্যাক্স লিমিটেড জয়েন্ট ভেঞ্চারে লাকসাম চিনকি আস্তানা প্রকল্পের কাজ পাওয়ার পরই কেন এ রকম অবান্তর প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলো যেখানে জয়েন্ট ভেঞ্চার দু’টি কোম্পানিকে বাদ দিয়ে ম্যাক্সকে দিয়ে কাজ করাবে এবং ম্যাক্সের নামে অভিজ্ঞতার সনদ জারি করাবে। এটা তাদের পূর্ব কৌশল ছিল। এই প্রস্তাবনা পুরো ক্রয় আইন, বিধি ও চুক্তির শর্তবহির্ভূত। কাজ পাওয়ার আগে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক আবশ্যিকভাবে লিড পার্টনার হিসেবে চীনা রেলওয়ের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়িত করেই চীনা রেলওয়ের সঙ্গে পার্টনারদের অন্তর্ভুক্তিতে গঠিত চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট, চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও ম্যাক্স লিমিটেড (সিআরএম) এই তিন জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে কাজ দেয়। ম্যাক্স লিমিটেড একটি প্রকল্পে জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে পরে নিজ নামে অভিজ্ঞতার সনদ পেতে পারে না। বিষয়টা আইনে সমর্থিত নয়। মূলত ১৬ কোটি টাকা কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ম্যাক্সকে ১৮০০ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতার যোগ্য করা না গেলে পরে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ১৮ হাজার কোটি টাকার কাজ দেয়া সম্ভব নয় বলেও এসব জালিয়াতি করা হয়। 

যেভাবে অভিজ্ঞতা সনদ নেয় ম্যাক্স: ম্যাক্স বলেছে, চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড তাদের রিসোর্সেস এদেশে আনতে পারবে না। নির্মাণকাজের মূল কম্পনেন্ট সরবরাহ করেছে লিড পার্টনার চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্যাডে এই সার্টিফিকেট দিয়েছে ওই প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকল্প পরিচালক নিজে। যৌথ কাজের লিড পার্টনার চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কারিগরি নির্দেশ মোতাবেক সময়মতো সরঞ্জাম সরবরাহ সম্পন্ন করেছে। তাহলে ম্যাক্স যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটা মিথ্যা ছিল। চীনা কোম্পানি দু’টি নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়ে শুধু ম্যাক্সের অনুকূলে অভিজ্ঞতার সনদ দেয়ার মিথ্যা কথা বলেছিল। কিন্তু তারাই রেলপথ নির্মাণের মূল উপাদান রেল সরবরাহ করেছিল। যার পরিমাণ ছিল ৭ হাজার টন। প্রশ্ন উঠে যে কীভাবে লিড পার্টনার চীনা রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ওই প্রকল্পের কাজের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেও নিজেদেরকে সম্পৃক্তহীন ঘোষণা দিয়ে ১০০ শতাংশ অভিজ্ঞতার সনদ ম্যাক্সকে দেয়ার শর্তকে সমর্থন করলো। এবং সেই শর্তকে প্রকল্পের পিডি ও ডিজি অনুমোদন দিল। এতে প্রমাণিত হলো কক্সবাজার প্রকল্পের সুযোগ পাওয়ার জন্য ম্যাক্স যাতে ওই প্রকল্প কাজের টেন্ডারে অংশ নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করতে পারে সেজন্যই এগুলো করা হয়েছিল। পরিষ্কারভাবে লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল চীনা কোম্পানি দু’টি। এবং তারা চুক্তি সম্পাদন করেছিল এবং যৌথভাবে কাজ শেষ করেছিল। অভিজ্ঞতার সনদ জারি হওয়ার কথা ছিল এই তিন কোম্পানির নামে। কোনো অবস্থায় ম্যাক্সের নামে নয়। ম্যাক্সকে সার্টিফিকেট দেয়ার সময় চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও পিডি শব্দগত ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল। তার তথ্য প্রমাণ এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এ ছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে হওয়া ক্রয় চুক্তিতে কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, নাজনীনা আরা কেয়া, লিয়াকত আলী খান, মফিজুর রহমান ও আবুল কালাম চৌধুরী। অনিয়মের বিষয়ে জানতে চেয়ে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কী অভিযোগ তা জানতে চান। বিস্তারিত জানানোর পরে লিখিত আকারে বক্তব্য দেবেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান ম্যাক্সের মিডিয়া বিভাগের কর্মকর্তা ইব্রাহিম খালিদ পলাশ। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ম্যাক্সের কেউ আর সাড়া দেননি। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacantoto4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d toto
slot toto
bacan4d
bacan4d
togel online
Toto Slot
saraslot88
Bacan4d Login
bacantoto
Bacan4d Login
bacan4d
bacan4drtp
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot maxwin
slot bacan4d
slot maxwin
bacan4d togel
bacan4d login
bacan4d login
bacan4d login
bacantoto 4d
slot gacor
bacansport
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot77 gacor
JAVHD
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
gacor slot
slot gacor777
slot gacor bacan4d
bacan4d
bacansport
toto gacor
bacan4d
bacansports login
slot maxwin
slot dana
slot gacor
slot dana
slot gacor
bacansports
bacansport
bacansport
bacansport
bawan4d
bacansports
bacansport
slot gacor
judi bola
slot maxwin
slot maxwin
bacansport
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot demo
slot gacor
slot gacor
slot gacor
toto slot
slot gacor
demo slot gacor
slot maxwin
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacansport
slot gacor
slot toto