রেলে নাশকতা ॥ একের পর এক, প্রতিরোধে যাত্রী তল্লাশিসহ একাধিক সিদ্ধান্ত, স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা
বন্ধ হচ্ছে না রেলে নাশকতা। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলপথ ও ট্রেনে নাশকতার ঘটনা ঘটছে। হরতাল ও অবরোধের নামে রেললাইন কেটে ফেলা, ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ, ফিশ প্লেট খুলে ফেলাসহ সারাদেশে প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানে নাশকতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত মঙ্গলবার রাতে দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায় রেল লাইনের ওপর স্লিপার ফেলে রাখে নাশকতার চেষ্টা করা হয়। এ সময় পার্বতীপুর থেকে খুলনাগামী আন্তঃনগর রূপসা এক্সপ্রেসের চালক তাৎক্ষণিক ট্রেনটি ব্রেক করায় শতাধিক যাত্রীর প্রাণ রক্ষা পায়।
এছাড়া গত মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি কোচ পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে আগুনে দগ্ধ হয়ে মা ও তিন বছর বয়সী শিশুসন্তানসহ চার যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত ১৩ নভেম্বর গাজীপুরের রেল লাইন কেটে ফেলার কারণে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে এক যাত্রী নিহত ও অর্ধশত যাত্রী আহত হয়।
চল্লিশ বছরেও এত নাশকতা হয়নি ॥ গত চল্লিশ বছরে রেলওয়ে এত বড় নাশকতার মুখোমুখি হয়নি বলে জানান গাজীপুরের লাইনচ্যুত ট্রেন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের চালক (লোকোমাস্টার) ইমদাদুল হক আহমেদ। ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় তিনি ও সহকারী চালক গুরুতর আহত হয়েছেন। বর্তমানে তারা কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বুধবার দুপুরে হাসপাতালের ৮ নম্বর কেবিনে কথা হয় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের চালক ইমদাদুল হক আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, ১৯৮৩ সালে শিক্ষানবিস সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দেন। বর্তমানের তার চাকরির বয়স ৪০ বছর। আর এক বছর আছে তার চাকরির বয়স। দীর্ঘ চাকরি জীবনের রেলওয়ের ওপর এভাবে নাশকতা কখনো দেখেননি তিনি। ২০১৪ সালেও এভাবে নাশকতা করা হয়।
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের চালক (লোকোমাস্টার) ইমদাদুল হক বলেন, ‘চাকরি জীবনে এত বড় দুর্ঘটনায় পড়িনি। তিনি এর আগে ২০১৪ সালে একবার ট্রেন চালানো অবস্থায় ইটের আঘাতে মাথা কেটে যায়। কিন্তু এবারের মতো বড় ঘটনা ঘটেনি। এভাবে রেল লাইন কেটে ফেলা নজিরবিহীন ঘটনা। ওইদিন মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে রাত ২টা ৫ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। গাজীপুরের দুর্ঘটনাস্থল পর্যন্ত আসতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। আগে থেকে একটি নির্দেশনা ছিল ট্রেন নিয়ন্ত্রণে গতি কমিয়ে চালানো। তাই ঘণ্টায় ৪০-৪২ কিলোমিটার গতিতে চালানো হয় ট্রেনটি। ভোর ৪ টা ১৬ মিনিটে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার প্রহল্লাদপুর ইউনিয়নের বনখড়িয়া স্থানে আসার পর একটি বড় ধরনের ঝাঁকুনি খায় ট্রেনটি। তখন সঙ্গে সঙ্গে গাড়িসহ ব্রেক করা হয়। এতে দুর্ঘটনা কিছু কম হয়েছে। তা হলে আরও দুর্ঘটনা ঘটে যেত।’
লোকোমাস্টার ইমদাদুল হক বলেন, ‘রেলের দুই ধরনের ব্রেকের পদ্ধতি রয়েছে। একটি গাড়ি (কোচ)সহ ব্রেক, অপরটি লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ব্রেক। লোকোমোটিভ ব্রেক করলে কোচগুলো সব উল্টে ইঞ্জিনের ওপর উঠে যায়। এতে হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়। তাই গাড়িসহ ব্রেক করা হয়েছে। সাধারণত ট্রেনের ব্রেক করার পর ৪৪০ গজ দূরে গিয়ে থামে। তাই ব্রেক করলেও সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন থামানো যায় না। আর ওইদিন রাতে ঘন কুয়াশার কারণে দূরে কিছু দেখাও মুশকিল ছিল।’ ট্রেনের দুর্ঘটনায় তার কোমর ও পায়ে আঘাত পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
গাজীপুরে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুতের ঘটনায় সহকারী লোকোমাস্টার মো. সবুজ মিয়াও গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনিও কমলাপুর রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালে এই রিপোর্টারের সঙ্গে কথা হয় তার। তিনি বলেন, ‘ওই দিন ওই রাতে প্রচুর কুয়াশা ছিল। রাজেন্দ্রপুর স্টেশন ছেড়ে ভাওয়াল গাজীপুর স্টেশনের সিগন্যাল দেখার চেষ্টা করছিলাম। সিগন্যাল দেখা যাচ্ছিল না। ভাওয়াল গাজীপুর স্টেশনের আগে আমরা যখন স্টেশনের কাছাকাছি আসলাম, তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম সিগন্যাল দেখার জন্য। একে তো স্টেশনের কাছাকাছি, আবার কুয়াশার কারণে সামনে বেশি দেখতে না পারায় গতি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। এমন সময় হঠাৎ লাইন থেকে চাকা পড়ে গেল। একটা বড় ঝাঁকুনি খেলাম।
নিয়ম অনুযায়ী আমরা ব্রেক কষলাম। কিছুক্ষণ রোলিং করে যাওয়ার পর ইঞ্জিন বাম দিকে কাত হয়ে যায়। হয়ত ওই জায়গার মাটি নরম ছিল এবং জায়গাটা ঢালু ছিল। এমন সময় ইঞ্জিনটা আনব্যালেন্সড (নিয়ন্ত্রণহীন) হয়ে যায়। ইঞ্জিন আনব্যালেন্সড হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা ঠিক ছিলাম। কিন্তু ইঞ্জিন আনব্যালেন্সড হওয়ার পর কোথায় আঁকড়ে ধরব, কীভাবে বাঁচব; এই সময়টা একটা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে গেছে। কিছু একটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ধরে রাখতে পারিনি।’
মো. সবুজ মিয়া বলেন, ‘ইঞ্জিন পুরোপুরি পড়ে থেমে যাওয়ার পর আমরা সেখানে অনেকক্ষণ পড়েছিলাম। এরপর আমি সোজা হলাম। দাঁড়িয়ে নিজেকে সুস্থ মনে হলো। তারপরও হাতেপায়ে প্রচ- ব্যথা পাচ্ছিলাম। আমি দাঁড়ানোর পর লোকোমাস্টার সাহেবের খোঁজ নিলাম। দেখলাম, তিনি আমারও নিচে চলে গেছেন। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ঠিক আছেন তো? তিনি আমাকে জবাব দিলেন, ঠিক আছি। কিন্তু তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। কোমরে ব্যথা পেয়েছেন। এরপর আমি বের হওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কোনো জায়গা আছে কিনা। ততক্ষণে লোকজন চলে এসেছে। আমার সামনের দরজা ছিল মাটির নিচে। আর লোকোমাস্টার সাহেবের সামনের দরজা ছিল উপরে। লোকজন প্রথমে আমাকে উপরের দরজা দিয়ে কোনোমতে বের করেন। কিন্তু এমএল সাহেব উঠতে পারছিলেন না। তারপর আমি দরজা টান দিয়ে ধরে রাখি এবং একজন লোক তাকে টেনে বের করেন।’
নাশকতা প্রতিরোধে তল্লাশিসহ একাধিক সিদ্ধান্ত ॥ রেলওয়ে সূত্র জানায়, হরতাল-অবরোধে নাশকতা প্রতিরোধে স্টেশনে প্রবেশের আগে যাত্রীর কঠোর নজরদারি ও সন্দেহজনক যাত্রীদের তল্লাশিসহ একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে ৪৪ জেলায় প্রায় ৩১ হাজার কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে নির্জন ও দুর্গম এলাকাসহ ঝুঁকিপূর্ণ শতাধিক পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় রেলপথের নিরাপত্তার জন্য এক একটি পয়েন্টে চারজন আনসার সদস্য, রেলওয়ে নিজস্ব বাহিনী (আরএনবি) ও রেলওয়ে পুলিশ (জেআরপি)সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে।
এছাড়া রাতের বেলায় ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ গতিতে ট্রেন চলাচলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ট্রেন চালুর আগেই স্টেশন ভিত্তিক মোটর ট্রলি ও পাইলট ইঞ্জিন পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে রেল সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘হরতাল-অবরোধের নাশকতা প্রতিরোধে সারাদেশের রেলপথ ও ট্রেনের নিরাপত্তার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। রেলওয়ের নিরাপত্তার জন্য একাধিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যে সব এলাকায় রেল লাইনের পাশে নির্জন ও ঝোপ-জঙ্গল রয়েছে সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এভাবে একাধিক পয়েন্ট চিহ্নিত করে অতিরিক্ত নিরাপত্তা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রাতের বেলায় ট্রেন যেন একটু দেখে-শুনে চলাচল করা হয় সেজন্য গতি একটু কমিয়ে দিতে বলা হয়েছে।’
স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা ॥ রেলওয়ের সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশের রেলওয়ের মোট রুট ৩০৯৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার, ট্র্যাক লাইনসহ মোট ৪৩২৪ দশিমক ৭৫ কিলোমিটার রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে। সারাদেশের রেলপথে আন্তঃনগর, কমিউটার, মেইল/লোকাল ও পণ্যবাহীসহ মোট প্রায় ৩০০ ট্রেন চলাচল করে। এ সব ট্রেন ও রেলপথের নিরাপত্তার জন্য বিপুল পরিমাণ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দরকার। কিন্তু সেই তুলনাই রেলওয়ে নিজস্ব বাহিনী (আরএনবি) ও জেআরপি সদস্য খুবই কম। তাই অতিরিক্ত আরও ২৭০০ জন আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রেলওয়ের নিরাপত্তায় যুক্ত হয়েছে এ সব আনসার সদস্য।
এছাড়া স্বয়ংক্রিয় ট্রেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা (এটিপিএস) চালুর বিষয়টি চিন্তা করছে রেলওয়ে। ট্রেনের সংঘর্ষ ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এই পদ্ধতি চালু হয়। এটিপিএস হলো ট্রেনের এক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যার বেশকিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ট্রেনের নির্দিষ্ট গতিসীমার ওপর লক্ষ্য রাখা এবং বিপদ সংকেত না মেনে এগিয়ে যেতে থাকলে দুর্ঘটনা এড়াতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থামিয়ে দেওয়া। এখন এ নিয়ে সমীক্ষার কাজ চলমান। আমেরিকা, জাপান এবং ইউরোপের দেশগুলো ইতোমধ্যে এটিপিএস চালু করেছে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতও এই পদ্ধতি চালু করেছে। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার পর কোনো ট্রেন যদি কর্মীদের ব্যর্থতার কারণে বিপদ বা লাল সংকেত পার হয়ে যায়, তাহলে ট্রেনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে যাবে এবং এতে করে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘হরতাল ও অবরোধ চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানের রেলওয়ে কোচে আগুন ও চলন্ত ট্রেনে পেট্রোল নিক্ষেপের ঘটনা বাড়ছে। তাই সারাদেশের রেলপথ ও ট্রেনের নিরাপত্তার জন্য ২৭০০ আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রেলওয়ে নিজস্ব বাহিনী আরএনবি ও রেলওয়ে পুলিশ সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও খালী বা যাত্রী কম কোচগুলোতে বাড়তি সতর্কতা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’