Bangladesh

র‍্যাব-ডিবির পোশাকে কারা করছে ছিনতাই

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রিং রোড। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে পূবালী ব্যাংকে জমা দিতে যাচ্ছিলেন মো. ইস্রাফিল। ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুর পৌনে ২টার দিকে হঠাৎ তাঁর সামনে দাঁড়ায় একটি প্রাইভেটকার। র‍্যাবের জ্যাকেট পরা দু’জন গাড়ি থেকে নেমে ইস্রাফিলের ব্যাগে কী, জানতে চায়। এক পর্যায়ে মারধর ও জোর করে প্রাইভেটকারে তুলে পিঠমোড়া করে তাঁর হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো এবং গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হয়। গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়ে ইস্রাফিলের ব্যাগে থাকা ৫ লাখ ৩৫ হাজার ও পকেটের আড়াই হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা। এর পর সোয়া ২টার দিকে শেরেবাংলা নগরের গণভবন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে যায় প্রাইভেটকারটি।

শুধু এটি নয়, একই আদলে রাজধানীর উত্তরা, কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সড়ক থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ ও স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর পেছনে কারা রয়েছে, তা শনাক্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা তদন্তে নেমেছে। জড়িতরা প্রকৃত র‍্যাব সদস্য, নাকি পেশাদার কোনো অপরাধী চক্র র‍্যাবের জ্যাকেট পরে অপকর্ম করছে, তা বের করতে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ক্যামেরাসহ প্রযুক্তিগত তদন্ত করছে। তবে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকে এ ধরনের ঘটনায় দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। একের পর এক ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীরা থানায় মামলাও করেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর পল্টনের আইএফআইসি ব্যাংকের ভেতর থেকে এক যুববকে টেনেহিঁচড়ে বের করে ২১ লাখ ৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন পুলিশের দুই সদস্য।

হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলার হুমকি

কসমো গ্রুপের কমার্শিয়াল অফিসার আশিকুল ইসলাম ৭ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কর্মস্থল থেকে বের হয়ে টাকা তুলতে উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের ইসলামী ব্যাংকের শাখায় যান সহকর্মী হাফিজ মিয়াকে নিয়ে। ৮ লাখ টাকা তোলার পর ওই ব্যাংকের আরেক হিসাব নম্বরে ৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জমা দেন। বাকি ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা নিয়ে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের উদ্দেশে রিকশায় রওনা হন। দুপুর সোয়া ২টার দিকে সোনারগাঁও জনপথ রোডে পৌঁছালে একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকার রিকশার গতিরোধ করে। প্রাইভেটকার থেকে র‍্যাবের জ্যাকেট পরা দু’জন নেমে আশিকুলকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। হত্যা মামলা রয়েছে জানিয়ে জোর করে দু’জনকে প্রাইভেটকারে তোলা হয়। এর পর উত্তরার ১০ নম্বর সেক্টরের কামারপাড়ার দিকে যেতে থাকে গাড়িটি। ভেতরে চিৎকার করলে তাদের মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। প্রাইভেটকারে মাঝেমধ্যে ওয়াকিটকি বাজতে থাকে। এক পর্যায়ে বলতে থাকে, টাকা না দিলে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। ব্যাংক থেকে তোলা সব টাকা ছাড়াও আশিকুল ও হাফিজের কাছে থাকা ৮ হাজার টাকা তারা নিয়ে নেয়। এর পর এটিএম কার্ড খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। এটিএম কার্ড না পেয়ে অফিসে ফোন করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আনার নির্দেশ দেয়। বন্দুকযুদ্ধে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। দুই ঘণ্টা ঘোরাঘুরির পর মোট ৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা নিয়ে বিকেল ৪টার দিকে হাফিজকে ১২ নম্বর সেক্টরের পার্কের সামনে এবং আশিকুলকে ১৭ নম্বর সেক্টরের শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটির সামনে ফেলে রেখে যায় ছিনতাইকারীরা।

কেরানীগঞ্জে ৩৪ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার ছিনতাই

কেরানীগঞ্জের জৈনপুর বাজারের পায়েল জুয়েলার্সের কর্ণধার সুনীল মণ্ডল। দোকান থেকে আনুমানিক ১০০ মিটার দূরে বাড়ি। প্রতিদিনের মতো ৪ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শেষে রাত পৌনে ৯টার দিকে বাসার উদ্দেশে রওনা হন সুনীল। দোকান থেকে বের হওয়ার সময় বন্ধকি ৩৪ ভরি স্বর্ণালংকার ও ২২ ভরি রুপা বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল নগদ ৮০ হাজার টাকা। কাপড়ের ব্যাগে স্বর্ণালংকার নিয়ে হেঁটে বাসার ফটকে পৌঁছামাত্র সিলভার রঙের একটি মাইক্রোবাস হেডলাইট বন্ধ করে সুনীলের কাছাকাছি আসতে থাকে। অজ্ঞাত দু’জন নেমে র‍্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে মাইক্রোবাসে উঠতে বলেন। এক পর্যায়ে সুনীলকে কিল-ঘুষি ও লাথি মেরে স্বর্ণালংকার ভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
মামলার এজাহারে সুনীল জানান, চালকসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৫ জন। তাদের মধ্যে দু’জনের গায়ে র‍্যাব লেখা জ্যাকেট ছিল, বয়স আনুমানিক ৩৫-৫৫ বছর।

সুনীল মণ্ডল বলেন, ‘র‍্যাব পরিচয়ে আমার কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা মুহূর্তের মধ্যে ছিনিয়ে নেওয়া হয়।’

মহাসড়কে বাস থামিয়ে ২০ লাখ টাকা ছিনতাই

সৌদিপ্রবাসী ইয়াকুব মোল্লা ২২ আগস্ট দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে টাঙ্গাইলের বিনিময় পরিবহনের একটি বাসে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করলে মির্জাপুরের শুভল্যা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন। সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার থেকে চারজন নেমে র‍্যাব পরিচয়ে বাসটি প্রথমে থামান। পাঞ্জাবি পরা ইয়াকুবকে টেনেহিঁচড়ে বাস থেকে নামিয়ে গাড়িতে তোলেন। এরপর গামছা দিয়ে চোখ বাঁধা হয়, দু’হাতে দেওয়া হয় হ্যান্ডকাফ। গাড়ির ভেতরে কিল-ঘুষি মেরে তাঁর সঙ্গে থাকা ১৯ লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টাকা নিয়ে নেয় তারা। ২টা ১০ মিনিটের দিকে জামুর্কী ফ্লাইওভার-সংলগ্ন ডুবাইল এলাকায় ইয়াকুবকে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ইয়াকুবের চাচাতো ভাই হেলাল মোল্লা মির্জাপুর থানায় মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়, ২৮ বছর সৌদি আরবে থাকার পর ৭ জুন দেশে ফেরেন ইয়াকুব। ঘটনার দিন তিনি প্রথমে টাঙ্গাইলের কাজীপুর গ্রামে বোনের বাসায় বেড়াতে যান। জমি কেনার জন্য স্ত্রীর ব্যবহৃত ৭ ভরি স্বর্ণ বিক্রি করেন। এ ছাড়া সৌদি আরব থেকে আনা আরও ১০ ভরি স্বর্ণ বিক্রি করেন। আর ব্যাংক থেকে কিছু টাকা তোলেন। সব টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সর্বস্ব হারান তিনি।

ইয়াকুবের চাচাতো ভাই হেলাল মোল্লা বলেন, ‘পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার ও ১০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে। আদালতের মাধ্যমে ওই টাকা পাওয়ার জন্য আমরা আবেদন করব।’

ডিবি পরিচয়ে পরানো হলো হাতকড়া

‘সোলার সিরামিকসের’ ডিলারশিপের ব্যবসা রয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুরের মো. জাকারিয়ার। ভাতিজা সাব্বির মিয়া তাঁর প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। ৭ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল ব্যাংকের জৈনাবাজার শাখা থেকে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা তোলেন সাব্বির। এ ছাড়া তাঁর কাছে আগে থেকেই ২ লাখ ৪১ হাজার ২০০ টাকা ছিল। মোট ৯ লাখ ১ হাজার ২০০ টাকা নিয়ে ঘটনার দিন বিকেল ৩টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় শ্রীপুরের নয়নপুরে পৌঁছলে ঢাকা মেট্রো-গ- ৩৭০৪৮৬ নম্বরের একটি প্রাইভেটকার অটোর গতিরোধ করে। ডিবির সদস্য পরিচয়ে সাব্বিরকে মারধর করে সব টাকা ছিরিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়।

কালিয়াকৈরের সাহেববাজারের ভাই ভাই স্টোরের মালিক দুলাল উদ্দিন দুদু। ১০ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে দোকানে যাওয়ার পথে কালিয়াকৈর বাইপাসের টেংলাবাড়ি এলাকায় পৌঁছলে সাদা রঙের একটি প্রাইভেটকার গতিরোধ করে। র‍্যাবের পোশাক পরা চারজন গাড়ি থেকে নেমে দুদুর বিরুদ্ধে মাদক মামলা রয়েছে জানিয়ে জোর করে গাড়িতে তোলে। মারধর করে তাঁর ১০ লাখ টাকা নিয়ে নেয়। এর আগে ৩১ মে কালিয়াকৈরের আজিজুল হক নামে আরেক ব্যবসায়ী থেকে রাস্তায় ডিবি পরিচয়ে ৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫৮৩ টাকা নিয়ে নেয়।

ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন, ‘ঘটনার দিন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কারখানার দিকে যাওয়ার পথে ডিবি পরিচয়ে আমাদের প্রাইভেটকারের গতিরোধ করা হয়। এর পর চারজন আমাদের গাড়িতে উঠে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয়।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও দুই ভুক্তভোগী জানান, কার প্রশ্রয় পেয়ে কীভাবে, কারা একের পর এক দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের জাল পেতেছে, বিশদ তদন্ত না হলে পেছনের লোকজনের মুখোশ উন্মোচিত হবে না।

একের পর এক একই কায়দায় ছিনতাইয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পেশাদার অপরাধীদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক পরে অপকর্ম করছে। এখন পর্যন্ত আমরা ১ হাজার ২০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছি, যারা ভুয়া র‍্যাব-পুলিশ পরিচয়ে অপরাধে জড়িত ছিল। নতুন করে যেগুলো ঘটেছে, এসবের সঙ্গে জড়িতরা সতিই র‍্যাব সদস্য কিনা, আমরা তদন্ত করে দেখছি। তারা র‍্যাব সদস্য হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এডিসি মৃত্যুঞ্জয় দে সজল জানান, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই-বাছাইসহ প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d