লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন বিনিয়োগে উচ্চাভিলাষী ব্যয়ে লাগাম

কালো মেঘে ঢেকে আছে দেশের অর্থনীতি। অনিশ্চয়তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। মাঠে চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রাম। প্রশাসনেও স্থবিরতা কাটছে না। সরকারি চাকরিজীবীরা কাজ-কর্ম বন্ধ করে প্রতিদিন পালন করছেন নানা কর্মসূচি। এমন বৈরী পরিবেশে বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগে মন্থরগতি বিরাজ করলেও আসন্ন বাজেটে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগে, এটি জিডিপির ৩০ দশমিক ২৫ শতাংশ। যদিও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি, ঋণের উচ্চ সুদের হার, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির মতো প্রতিবন্ধকতা এখন বিরাজমান। তবে বাজেটে আকার না বাড়িয়ে ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছেন অর্থ উপদেষ্টা। আসন্ন বাজেটে মোট ব্যয় চলতি বাজেটের তুলনায় কম হচ্ছে।
সূত্র মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সম্ভাব্য বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৮ লাখ ৮৯০ কোটি টাকা। চলতি বাজেটের তুলনায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট বিনিয়োগের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ১৬ লাখ ৯৩৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩০ শতাংশ।
এদিকে বিনিয়োগ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা উচ্চাভিলাষী ও অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসাবে তারা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ও মার্কিন ডলারের ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছেন। ব্যবসায়ীদের মতে, টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা এখনো একটি চ্যালেঞ্জ। এই প্রেক্ষাপটে বড় বিনিয়োগ করা মানে বিরাট ঝুঁকি বলে মনে করছেন তারা।
অর্থ বিভাগ সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় ধরে আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট প্রায় চূড়ান্ত করছে। শেষ সময়ে ব্যয় কিছুটা বাড়তে বা কমতে পারে। জাতীয় সংসদ না থাকায় আগামী ২ জুন সোমবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে নতুন বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা। তবে বিনিয়োগের উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখলেও তিনি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরছেন।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে জানান, আগামী বাজেটে বিনিয়োগকে বের্শি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।। এর সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে প্রাইভেট সেক্টরের (বেসরকারি খাত) উন্নয়ন কিভাবে আনা যায় সেখানেও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আমি বলব-যেটা বাস্তবায়ন করতে পারব, সে আলোকে আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার এবং অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো থাকবে।
এদিকে বিদ্যমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভয়াবহ বিনিয়োগ কমছে। এর প্রমাণ মিলছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১১৫ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আমদানি ৩০ দশমিক ১০ শতাংশ কম। মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি হ্রাস পাওয়ার অর্থ নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। নতুন বিনিয়োগ হলেই কেবল মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি বৃদ্ধি পায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, বিনিয়োগের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে না। এর এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি দুটো গত বছরের তুলনায় নেতিবাচক। সে প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের জন্য বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে অর্থনীতি বর্তমান আছে এবং আগামীতে যাবে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাই সবচেয়ে বড়। পাশাপাশি এ সরকার যেসব নীতিপ্রণয়ন করছে সে ধারাবাহিকতা থাকবে কিনা, নতুন সরকার এসে বিনিয়োগের জন্য নতুন কোনো পদক্ষেপ নেবে কিনা সে সম্পর্কে কারোই ধারণা নেই, বিনিয়োগকারীদেরও নেই। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ আসাটা কঠিন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন। সেক্ষেত্রে নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নতুন বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৫ লাখ ১৪২ কোটি টাকা, এটি মোট জিডিপির ২৪ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য তিন লাখ ৭৪৮ কোটি টাকা, জিডিপির ৬ শতাংশ।
চলতি বাজেট নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ লাখ ৫৬০ কোটি টাকা, জিডিপির ২৪ দশমিক ০২ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ তিন লাখ ৩৭৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
বিনিয়োগ আগামীতে বাড়ানো হচ্ছে। তবে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সাময়িক তথ্য শঙ্কা তৈরি করেছে। সেখানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২২ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আগের অর্থবছরে তা ছিল ২৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এটি করোনা মহামারির সময় অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরের পর সবচেয়েও কম। ব্যবসায়ীদের মতে, এটি কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি বিনিয়োগ পরিবেশের প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতা। কারণ গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও সরবরাহে অসামঞ্জস্যতা, ক্রমবর্ধমান আমদানি ও তারল্য সংকটে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর মতো ব্যবসায়িক পরিস্থিতির অবনতির দিকে ইঙ্গিত করেন।
এদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। আজ রোববার চীনের ২৫০ জন বিনিয়োগকারীর উপস্থিতিতে ঢাকায় বিনিয়োগ ভবনে দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ঢাকায় আরও একটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থ উপদেষ্টাকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।