লাখ লাখ সংশোধনের আবেদন
চারদিকে কত কী বদলে যাচ্ছে, কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনে অব্যবস্থাপনার ছবিটা বদলাচ্ছে না। সংকটটা যে তিমিরে ছিল সেখানেই আছে। বরং কোথাও কোথাও বেড়েছে। দরকারি জিনিসটির সুলভ সেবাটাই এখনো দুর্লভ।
মানুষ যে কতটা হয়রানি হচ্ছে তা বোঝার জন্য একটি সংখ্যাই যথেষ্ট। যদিও সংখ্যায় দুর্ভোগের অন্তজ্বালাটাই থাকে না। এক দিনে কত লোক এনআইডি সংশোধনের আবেদন করলে তা দুর্ভোগ বোঝানোর জন্য যথেষ্ট হবে? ৫০০ বা ১০০০ জন! এই সংখ্যাগুলোও যথেষ্ট নয়। এক দিনে সারা দেশে ৫ হাজার লোক তাদের এনআইডি সংশোধনের জন্য আবেদন করছেন। গত ১ জানুয়ারি এ ঘটনা ঘটেছে। যেকোনো ছুটির দিনও দেড় হাজারের বেশি লোক তাদের এনআইডি সংশোধনের জন্য অনলাইনে বসেন।
ভুল এনআইডি নিয়ে জেরবার আমজনতা। কারও নামের বানান ভুল। কারও জন্মের তারিখ নেই। কারও স্বামীকে লেখা হয়েছে পিতা। ভুল রয়েছে ঠিকানাতেও। অনেকে পাল্টাতে চান বয়স। নানা পর্যায়ে এসব ভুল ধরা পড়ছে। পাসপোর্টের সঙ্গে লিংক করাতে গিয়েই এই ভুল নজরে আসছে সবচেয়ে বেশি, যা সংশোধন করতে গিয়েই হুড়োহুড়ি। দিশা পান না সংশোধন পথের। ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হয়ে একসময় নিজেকে দেখতে পান সর্বত্র জাঁকিয়ে বসা দালালের মুষ্টিতে।
নির্বাচন কমিশনের এনআইডি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে ১১ লাখ ৭৬ হাজার সংশোধনের আবেদন জমা পড়ে নির্বাচন কমিশনে। আবেদনকারীদের ফি জমা পড়ে ২৯ কোটি ৮৫ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ২০২২ সালে ১৫ লাখ ৩১ হাজার সংশোধনের আবেদন জমা হয়। ওই বছর আবেদনকারীদের ফি জমা হয় ৩৮ কোটি ৩৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। ২০২১ সালে ৯ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি সংশোধনের আবেদন জমা পড়ে নির্বাচন কমিশনে। আবেদনকারীদের ফি বাবদ ২৪ কোটি ২৭ লক্ষাধিক টাকা জমা হয়।
এভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্ফীত হয়, সাধারণের হয়রানিটাও বাড়ে সমানতালে।
গত ২২ অক্টোবর জাতীয় পরিচয়পত্রের ‘ডাকঘর’ ভুল সংশোধনের আবেদন করেন রাজবাড়ীর রাশেদুজ্জামান। সংযুক্তি হিসেবে জন্মসনদ, নাগরিক সনদ, চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, পিতার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কয়েক ধরনের কাগজপত্র। ৩৫০ টাকা ফি দিয়ে ৪ মাস পেরিয়ে গেলেও ছোট্ট ভুলটি শোধরাতে পারেননি তিনি। একাধিকবার ঘুরেছেন নির্বাচন কমিশনের স্থানীয় অফিসে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছোট্ট ভুল, কিন্তু ভোগান্তি অনেক বেশি। তবে কাগজটি এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে যতই হয়রানি হোক সংশোধন করতেই হবে।’
কী কাজে লাগে এনআইডি এই প্রশ্ন শুনলে যে কেউই অবাক হন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পাল্টা প্রশ্ন করেন, কী কাজে লাগে না? এখন এনআইডি ছাড়া কিছু হয়? বিদেশ যাবেন? পাসপোর্ট করাতে প্রথমেই চাই এনআইডি। চাকরির আবেদন করবেন? এনআইডি ছাড়া কোনো সুযোগই নেই। জমি কেনাবেচায়, ব্যাংক হিসাব খুলতে, কর দিতে, মোবাইলের সিম কার্ড কিনতে, সরকারি ভাতা পেতে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে এনআইডি থাকা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের ১১৭টি কাজে এনআইডি থাকতে হয়। এসব সুবিধা পেতে বিভিন্ন তথ্যের মিল থাকতে হয়। অনেক সময় ব্যক্তির কারণে এনআইডিতে ভুল তথ্য থাকে। আবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেও ভুল তথ্য থাকে। এসব ভুল সংশোধন করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়।
নাম, পিতা-মাতার নাম ও জন্মতারিখ সংশোধনে ২৩০ টাকা ফি জমা দিতে হয়। দ্বিতীয়বারের জন্য দরকার হয় ৩৪৫ টাকা। এ ছাড়া এনআইডি কার্ডের অন্যান্য তথ্য সংশোধনের জন্য ১১৫ টাকা এবং উভয় ধরনের তথ্য সংশোধনের জন্য ৩৪৫ টাকা লাগে। পরবর্তী যতবার আবেদন করবেন ভ্যাটসহ ৫৭৫ টাকা ফি দিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য, পেশা, ড্রাইভিং লাইসেন্স-সংক্রান্ত তথ্য, পাসপোর্ট তথ্য, ধর্ম, স্বামী/স্ত্রীর নাম, ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বর-সংক্রান্ত তথ্য থাকতে হয়। এনআইডির অন্যান্য তথ্য সংশোধন করতে চাইলে সরকার নির্ধারিত ফির সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, নির্বাচন কমিশনের ফি তো আছেই। এর সঙ্গে যোগ হয় যে দোকান থেকে আবেদন করা হয়, সেই দোকানদারের সার্ভিস চার্জ, যা স্থানভেদে এক থেকে দুইশ টাকা। এগুলোর সঙ্গে আছে যাতায়াত, দালালের টাকা। কাজেই শুধু ফি দিয়ে বছরে কত টাকা এনআইডি সংশোধনে ব্যয় হয় তা নির্ধারণ করা ঠিক হবে না।
জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংরক্ষিত তথ্য-উপাত্ত (সংশোধন, যাচাই ও সরবরাহ) প্রবিধানমালা ২০১৪-এর প্রবিধি ২(৫) অনুযায়ী জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদনে ৪টি ক্যাটাগরি করা হয়েছে। ‘ক’ ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তির জন্য উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ‘খ’ ক্যাটাগরির আবেদনের জন্য জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও ‘গ’ ক্যাটাগরির আবেদনের জন্য আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং ‘ঘ’ ক্যাটাগরি আবেদন নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী রাজবাড়ীর সবুর শেখ বলেন, ‘নাম সংশোধনীর জন্য দুই বছর আগে আবেদন করেছি। জন্মসনদ, কাবিননামাসহ চাহিত সব কাগজপত্র দিয়ে আবেদন করেছিলাম। এখনো পেন্ডিং দেখাচ্ছে।’
একই জেলার মনিরুল খান বলেন, ‘পাসপোর্টের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের নামের ভুল থাকায় আবেদন করেছিলাম। আবেদন দুবার বাতিল করায় আর আবেদন করা হয়নি।’ ইতি রানী বলেন, ‘আমার জাতীয় পরিচয়পত্রে পিতা-মাতার নামের স্থলে শ্বশুর-শাশুড়ির নাম রয়েছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করেছিলাম কয়েক মাস আগে। এখনো কোনো মেসেজ আসেনি।’
এনআইডি নিয়ে হয়রানির বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও অবগত। এ কারণেই এনআইডির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিতে জাতীয় সংসদে বিল পাস হয়েছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন বিল, ২০২৩’ পাস হয়। নতুন আইনটি কার্যকর হলে ২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন রহিত হবে।
আইনে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য একজন ‘নিবন্ধক’ থাকবেন। সরকার তাকে নিয়োগ দেবে। নিবন্ধক ও নিবন্ধকের কার্যালয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে শুরু না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে পারবে। সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে যে তারিখ নির্ধারণ করবে, সে তারিখ থেকে এই আইন কার্যকর হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সংসদে পাস হওয়ার পর তারা এর বাস্তবায়ন নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। এরই মধ্যে খসড়া জনবল কাঠামো করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় নিবন্ধকের কার্যালয় থাকবে। তার অধীনে উপজেলায়ও অফিস থাকবে। অফিস ও জনবল কাঠামো নিয়ে কাজ শুরু করতে পারলে সাধারণ মানুষ এনআইডি নিয়ে যে ভোগান্তিতে পড়েছেন, তা আর থাকবে না।
কত দিন লাগতে পারে জনবল কাঠামো চূড়ান্ত হতে, জানতে চাইলে সুরক্ষা সেবা বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, যেকোনো জনবল কাঠামো করাই কঠিন কাজ। একটা কাঠামো দাঁড় করালেই হবে না। তাদের কর্মপরিধি নির্ধারণ করতে হবে। তাদের বেতন-ভাতা কোথা থেকে আসবে তা দেখতে হবে। এসব যাচাই-বাছাই করবে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়। এই দুই মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে বিষয়টি যাবে প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে। এরপর শুরু হবে কার্যালয় স্থাপনের কাজ।
তিনি বলেন, ‘রুটিনমতো করলে এ কাজে বছরের পর বছর চলে যাবে। আমাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করার সময় নেই। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ চলছে।’