লেবাননে ইসরায়েলের ‘অঘোষিত’ আগ্রাসন, নেতানিয়াহু কি এরমধ্যেই জিতে গেছেন?
গত সেপ্টেম্বর মাসে যখন হিজবুল্লাহ’র যোগাযোগের ডিভাইসগুলোতে পেতে রাখা বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হয়– তখনই নেতানিয়াহু ও তার ডানপন্থী লিকুদ পার্টির সমর্থন বিপুল হারে বাড়তে শুরু করে। লেবাননে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার পর যা আরো বাড়ে– বিশেষত হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর।
গাজা যুদ্ধ শুরুর পর প্রায় এক বছর ধরে উত্তাল ছিল ইসরায়েলের রাজনীতি। এসময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জনপ্রিয় অনেক বিক্ষোভ হয়েছে। মাথার ওপর ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার অভিযোগ থাকা এই উগ্রবাদী নেতা, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সেখান থেকে যেন সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ইহুদিবাদী এ নেতা, লেবাননে আক্রমণ শুরুর পরে তার দেশশাসন বেশিরভাগ ইসরায়েলির কাছে আবারো গ্রহণযোগ্য হচ্ছে।
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় এরমধ্যেই মারা গেছেন ২ হাজারের বেশি লেবানিজ, ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। হিজবুল্লাহ’র যোগাযোগ যন্ত্রগুলোয় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সংগঠনটির বহু সদস্যকে হতাহত করার পরে – লেবাননে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল, তারপরে স্থলপথে আগ্রাসনও শুরু হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে যখন হিজবুল্লাহ’র যোগাযোগের ডিভাইসগুলোতে পেতে রাখা বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হয়– তখনই নেতানিয়াহু ও তার ডানপন্থী লিকুদ পার্টির সমর্থন বিপুল হারে বাড়তে শুরু করে। লেবাননে যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার পর যা আরো বাড়ে– বিশেষত হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যার পর।
ইসরায়েলিদের মধ্যে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে রয়েছেন নেতানিয়াহু। তার বিরুদ্ধে সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়েছে এই প্রেক্ষাপটে। কিন্তু, এরমধ্যে তার মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন সাবেক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গিডিয়ন সার, আর এই ঘটনা ভবিষ্যতে নেতানিয়াহুর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
আগ্রাসনের আগে ইসরায়েলি রাজনীতিতে কতোটা বিভক্তি ছিল?
এক কথায় বলতে হলে, তা ছিল ‘ব্যাপক’।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পরে নেতানিয়াহু যখন তার জরুরি যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন; এসময় তার নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটের কত জন সদস্য বিরোধিতা করবেন বা সমর্থন দেবেন– জটিল সেই সমীকরণ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়েছে তাকে।
নেতানিয়াহুর প্রতি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনাস্থার ঘটনা ছিল— এই মন্ত্রিসভা থেকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বেনি গান্তজের পদত্যাগ। গান্তজ জুনে পদত্যাগ করেন, তার সঙ্গে নেসেটের ৮ আসনের সমর্থন হারায় নেতানিয়াহুর সরকার, এটি তার রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হলেও – নেসেট আইনপ্রণেতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না হারানোর ফলে সে যাত্রাতেও টিকে যান।
হামাসের সাথে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ইসরায়েলের পরিকল্পনা কী হবে, এবং হামাসের হাতে বন্দি জিম্মিদের মুক্ত করতে একটি চুক্তি সই– মূলত এসব বিষয়কে কেন্দ্র করেই নেতানিয়াহুর সাথে গান্তজের বিরোধের সূত্রপাত হয়।
নাসরাল্লাহ’কে হত্যার সংবাদ জানার পর অতীতের সেই তিক্ততা ভুলে টুইটারে (বর্তমানে ‘এক্স) একটি পোস্ট দিয়েছনে বেনি গান্তজ, তিনি একে ‘যুগান্তকারী মুহূর্ত’ এবং ‘ন্যায়বিচার’ বলে মন্তব্য করেন।
তার চেয়েও নাটকীয় হচ্ছে, নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচক গিডিয়ন সারের জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় ফিরে আসা। তার যোগদানের ফলে নেসেটের চারটি আসনের সমর্থন পেয়ে আরও মজবুত অবস্থানে থাকবে জোট সরকার। একইসঙ্গে সরকারের দুই মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির ও বেজালেল স্মোত্রিচের নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্টের অতি-ডানপন্থীদের ভেটো ক্ষমতাও হ্রাস করবে এই সমর্থন।
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হিজবুল্লাহর সদর দপ্তরের কম্পাউন্ডে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন হাসান নাসরাল্লাহ।
নেতানিয়াহুর জনসমর্থনে ভাটা কেমন ছিল?
অনেকটাই যে তা বলাই যায়।
গেল বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলার জন্য বেশিরভাগ ইসরায়েলি নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা কাজ করেছে বলে মনে করতেন। ওই সময়ে হিব্রু ভাষার দৈনিক মারিভের এক জরিপে দেখা যায়, মাত্র ২৯ শতাংশ ইসরায়েলি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করেন। জরিপে অংশ নেওয়াদের ৪৮ শতাংশ তার প্রতিপক্ষ গান্তজকে সরকার প্রধান হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ওই পত্রিকার আরেকটি জরিপে অংশ নেওয়া শতকরা ৮০ ভাগ ইসরায়েলি জানান, নেতানিয়াহু ৭ অক্টোবরের হামলা ঠেকানোর ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুক– এটা তারা চান।
এরপর নেতানিয়াহু যেভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন– সেটাও ইসরায়েলিদের মধ্যে খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
গত এপ্রিলে জেরুজালেমে লাখো জনতার এক বিক্ষোভ সমাবেশ হয়– নেতানিয়াহুর পদত্যাগ এবং জিম্মিদের মুক্তির জন্য একটি চুক্তির দাবিতে।
ওই সময় ইসরায়লের গণমাধ্যম চ্যানেল-১২ এর এক জরিপে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের মাত্র ৩৮ শতাংশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহুকে সমর্থন করেন। তবে বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদের পক্ষে থাকা ২৭ শতাংশ সমর্থনের চেয়ে এগিয়েই ছিলেন।
বাম থেকে – বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও বেনি গান্তজ।
এখন নেতানিয়াহু তাহলে কি অপ্রতিরোধ্য?
আসলে তাও কিন্তু নয়।
নেতানিয়াহুর দীর্ঘদিনের একজন সমালোচক ও সাবেক ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত অ্যালন পিনকাস আল জাজিরাকে বলেন, ‘পশ্চিমা খবরের কাগজে যারা কাজ করেন, তাঁদের অনেকে মনে করেন, জনমত জরিপে এখন নেতানিয়াহুর উত্থান দেখা যাচ্ছে। যেন তিনিই আছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু, বাস্তবে তা নয়।’
‘(হিজবুল্লাহ’র) পেজার ডিভাইসে হামলা ও নাসরাল্লাহকে হত্যার পরে তার জনপ্রিয়তা অনেকটাই বাড়ে, কিন্তু সেটা অল্প সময় স্থায়ী হয়েছে। এখন আবার সব স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।’ এসব সাফল্যের পরে নেতানিয়াহু নিজেকে ইসরায়েলিদের একজন ঐশ্বরিক পরিত্রাতা হিসেবে জাহির করছেন, যা অনেককে হতাশ ও ক্ষুদ্ধ করেছে এমনটাও তিনি উল্লেখ করেন।
পিনকাস বলেন, ‘সম্প্রতি লেবানিজদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন নেতানিয়াহু, সেখানে তিনি তাদের হিজবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার এবং লড়াই করার আহ্বান জানিয়েছেন, যা সত্যিই উদ্ভট।’
তিনি জানান, ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের শত্রু হিজবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে আক্রমণ করে পাওয়া প্রাথমিক সাফল্যের উচ্ছ্বাসে এরমধ্যেই ভাটা পড়ছে। একইসঙ্গে গাজায় ইসরায়েলি জিম্মি থেকে যাওয়ার ঘটনাও প্রধানমন্ত্রীর নতুন চাকচিক্যকে মলীনই করছে।
কিছুদিন আগেই জিম্মিদের ফেরত আনতে কোনো চুক্তি করা নাহলে– সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন না করার ঘোষণা দিয়েছেন ১৩০ জন ইসরায়েলি।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার এক বছর পূর্তিতে রাজধানী তেল আবিবে মৌন প্রতিবাদে অংশ নেন ইসরায়েলি জিম্মিদের স্বজনেরা।
নাসরাল্লাহকে হত্যার কিছুদিনের বিরতির পর নেতানিয়াহু বিরোধীদের বিক্ষোভও আবার শুরু হয়েছে। গত শনিবার রাতে রাজধানী তেল আবিবের রাস্তায় বিক্ষোভ হয়, আনুমানিক ১০১ জন ইসরায়েলি জিম্মি এখনও রয়েছেন গাজায়, যাদের মুক্ত করতে ব্যর্থ হলে বিক্ষোভকারীরা আবারো নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন।
তার চেয়েও বড় অসন্তোষ যা নিয়ে তা হলো– দুই ফ্রন্টের যুদ্ধ নিয়েও প্রকাশ্য পরিকল্পনা নেই। এই অবস্থায়, যতটা সম্ভব জনসমর্থন জোটাতে নেতানিয়াহুকে এখনো সচেষ্ট থাকতে হচ্ছে।