Hot

শতাব্দীতে এমন বছর কমই আসে

দুই হাজার চব্বিশ। ইতিহাস বদলে দেয়া এক বছর। শুরুটা হয়েছিল ডামি নির্বাচনের মধ্যদিয়ে। এরপর একের পর এক ঘটনা। জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অগ্নিরূপ। আগস্টে তা রূপ নেয় ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে। ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এই আন্দোলনে দেড় হাজারের বেশি মানুষ জীবন দিয়েছেন। আহত হয়েছেন ত্রিশ হাজার। অসংখ্য জীবন আর রক্তের বিনিময়ে নতুন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ৮ই আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয় নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় সামনে রেখে। পরের একের পর এক সংস্কার পরিকল্পনা সামনে আসে। ইতিমধ্যে চার মাস পার করেছে নতুন সরকার। নানা সম্ভাবনার হাতছানি নিয়ে শুরু করা সরকারের প্রতি মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশাও ছিল। এখন প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক খুঁজতে শুরু করেছে মানুষ। সংস্কার আর নির্বাচনের বিষয়ে দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থা নিয়ে নতুন বছরে পা রাখছে দেশ। মানুষের প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার ফারাক থাকলেও তৈরি হওয়া আকাশ সমান উঁচু স্বপ্ন ক্রমে নিচু হয়ে আসলেও ২০২৪ সাল ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকবে বিপ্লবের বছর হিসেবে। ’২৪-এর এই বিপ্লবের কারণেই ইকোনোমিস্টের বর্ষসেরা দেশের তালিকায় নাম উঠেছে বাংলাদেশের। এবারের জুলাই ছিল ইতিহাসের বাঁক বদলের এক সন্ধিক্ষণ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের চলা কর্মসূচির মধ্যে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বিরোচিত জীবন দান বদলে দিয়েছিল আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। পুলিশের বন্দুকের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যাওয়া আবু সাঈদ হয়ে উঠেছিল ’২৪-এর আন্দোলনের বীর চরিত্র। তার এই সাহস বুকে ধরে শিক্ষার্থী-ছাত্রনেতার আন্দোলনের তোড়ে উপড়ে যায় ১৫ বছরের বেশি সময় স্থায়ী চরম কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী শাসন। শহীদ আবু সাঈদ হয়ে উঠেন ’২৪-এর সেরা মানব। 
ডামি নির্বাচন ও একতরফা নির্বাচন: বহু নাটকীয়তা, আন্দোলন, বিতর্ক এবং শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর চাপের মধ্যেই এই বছরের ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দেশের ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্কজনক নির্বাচন। আওয়ামী লীগ সরকারের একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতি দেখে ওই নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি, জামায়াতসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। প্রতিপক্ষবিহীন নির্বাচনকে জমজমাট করতে অভিনব কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সমমনা জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ ১৪ দল থেকে সমঝোতার মাধ্যমে আলাদা প্রার্থী মাঠে নামায় আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে নৌকা প্রতীকে নিজ দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায় দলটি। নিজেদের প্রতিপক্ষ নিজেরাই, নির্বাচনে নজিরবিহীন এবং অভিনব এসব প্রার্থীদের নাম শেখ হাসিনা নিজেই রাখেন ডামি প্রার্থী। এই নির্বাচনটি ডামি নির্বাচন নামেই খ্যাতি পেয়েছে। এ ছাড়া এই নির্বাচনের ফল নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও ভোটার হার অস্বাভাবিক দেখানো হয়। কলঙ্কজনক এই নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখে শেখ হাসিনা সরকার। তবে নির্বাচনের পরেও এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে দেশে-বিদেশে। এ ছাড়া বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও নির্বাচন মান নিয়ে প্রশ্ন তোলে। 

ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত বিপ্লব, শেখ হাসিনা সরকারের পতন: জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর থেকে পতনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারকে কোনো রকম ঝক্কি-ঝামেলায় পড়তে হয়নি। এই সময়ে দেশে বড় ধরনের কোনো আন্দোলনও হয়নি। ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এই কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক কোটাবিরোধী আন্দোলন হয়। সে সময় সংস্কারের দাবির বিপরীতে পুরো কোটা ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয় সরকার। চলতি বছর ৫ই জুন সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার রায় দেয় হাইকোর্ট। সংস্কারের দাবিতে আবারও আন্দোলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে আন্দোলন বড় হতে থাকে। শুরুতে আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। গত ১৪ই জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোটা ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ নিয়ে এক মন্তব্য আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালে। তিনি নিজের চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ আন্দোলনকারীদের বিষয়ে তার এই মন্তব্য ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবানলে আরেক দফা ঘি ঢালেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কতিপয় নেতারা যেসব বক্তব্য রেখেছে, তার জবাব দেয়ার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।’ এরপর ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা করে। রক্তাক্ত হন অনেকে। সেসবের মুহূর্ত অনলাইন ও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেলে আন্দোলনের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এক রাতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

১৬ই জুলাই রংপুরে নিহত হন শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। বিক্ষোভ দমনে পুলিশের আগ্নেয়াস্ত্রের বিপরীতে দুই হাত উঁচু করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পুলিশের ছররা গুলিতে প্রাণ ঝরে আবু সাঈদের। তার মৃত্যুর দৃশ্য মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তীব্রতা বাড়তে থাকে আন্দোলনের। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। লাশের মিছিল বাড়তে থাকে, সেইসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। পরবর্তী কয়েকদিন সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়। কারফিউ জারি করে কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, ছররা গুলির পাশাপাশি ‘লাইভ বুলেট’ ব্যবহার করে পুলিশ। হেলিকপ্টার থেকেও গুলি করা হয় আন্দোলনকারীদের ওপর। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। ব্যাপক প্রাণহানি ও নৃশংসতায় আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলন কিছুটা দমন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে আদালত কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি পুনর্বহালের পরিবর্তে সংস্কার করে। ৫৬ শতাংশ থেকে কোটা ১০ শতাংশে নেমে আসে। এদিকে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন পরিণত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। বুলেট আর ব্যাপক প্রাণহানির মাধ্যমে সরকার রাস্তা থেকে আন্দোলনকারীদের কিছুটা সরাতে পারলেও ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে দেশের জনগণ। সেই ক্ষোভ আরও উস্কে দেয় ঘরে ঘরে হানা দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা। এর মধ্যে সামনে আসে ভাতের হোটেল খ্যাত ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদের নাটক। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের ডিবি অফিসে বসিয়ে ভাত খাওয়ানো এবং সেই ছবি-ভিডিও প্রচার করা, তাদের দিয়ে জোর করে বিবৃতি দেয়ার ঘটনা আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ করে। মানুষও ক্ষুব্ধ হয়ে আবার রাস্তায় নামতে শুরু করে। সরকার আরও কঠোর হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড ৪ঠা আগস্ট মাঠে নামায় দলের নেতাকর্মীদের। সেদিন ঢাকার পাশাপাশি, নরসিংদী, ফেনী, হবিগঞ্জ, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় তীব্র সংঘাত হয়। ঝরে অনেক প্রাণ। তবে জনরোষের ?মুখে ময়দানে টিকতে পারেনি আওয়ামী লীগ। শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনীকেও ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর বড় অংশ ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে অস্বীকৃতি জানায়। সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেন, করেন মিছিলও। ৫ই আগস্ট সকাল থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের মানুষ শেখ হাসিনাকে গদি থেকে উৎখাতের জন্য গণভবনের দিকে ছুটতে থাকে। শেখ হাসিনা গণভবন থেকে সটকে পড়তে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পান। তীব্র জনরোষের মুখে সেদিন দুপুরে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন টানা চারবারসহ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনা।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠন: গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ই আগস্ট যাত্রা শুরু করে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার। এরপর প্রায় পাঁচ মাস কেটে গেছে। এ সময়ে সরকার অনেক ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এ ছাড়া নেয়া হয়েছে সংস্কারের উদ্যোগ। এজন্য প্রায় ১৫টি কমিশন গঠন করেছে এই সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্কার কমিশনগুলো হলো- নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বিচার বিভাগ, পুলিশ সংস্কার কমিশন। সংস্কার কমিশনগুলোকে সংস্কারের সুপারিশ দিতে ৯০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বেশ কয়েকটি কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেবেন। নানা প্রত্যাশা নিয়ে এই সংস্কার উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন নির্বাচন নিয়ে বেশি আলোচনা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের প্রধান দাবিও এটি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button