Bangladesh

শরিকদের আসন কমছে ‘বিরোধীদের’ ভাগ্যে কী

আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার কথা বললেও ভোটে জেতা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীনদের শরিক এবং মিত্র দলগুলো আসন সমঝোতা চায়। তবে আওয়ামী লীগ ভোটের মাঠে দুর্বল এই দলগুলোকে তাদের প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন দিতে রাজি নয়। ১৪ দলের চার শরিকের আটটি আসন থাকলেও তাদের পাঁচটির বেশি আসন ছাড়তে চাইছে না। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও কিংস পার্টি নামে পরিচিতি পাওয়া দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা নিশ্চিত হয়নি। প্রত্যাশিত ভাগ নিশ্চিত না হওয়ায় কৌশল হিসেবে জাপা সরকারি দলের সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্বীকার পর্যন্ত করছে না।

যদিও মঙ্গলবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আভাস দেন, জাপার সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা হতে পারে। সন্ধ্যায় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু জানান, আজ বুধবার আলোচনা হবে জাপার সঙ্গে। এরই মধ্যে জাপা সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু গণভবনে যান। 

তবে এ খবর অস্বীকার করে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘গণভবনে যাইনি। অন্য কোথাও বৈঠক করেছি।’ এক পর্যায়ে জানান, দলের নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণে আনিসুল ইসলাম মাহমুদের গুলশানের বাসভবনে তিনি এবং জি এম কাদের বৈঠক করেছেন। 

বৈঠকের আলোচ্যসূচি বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আওয়ামী লীগ আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। জাপা আলোচনায় যাবে কিনা, তা নিয়ে বৈঠক হয়। তবে সিদ্ধান্ত হয়নি। জাপা মহাসচিব আবারও দাবি করেন, তাঁর দল আসন সমঝোতা করবে না; কারও সঙ্গে জোটও করবে না। 

অবশ্য জাপা প্রার্থীরা খোলাখুলিই বলছেন, জয়ের জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা জরুরি। ঢাকা-৬ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী ও জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘২০ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। এখন কি চাইলেই ভোটের মাঠে তাদের  প্রতিপক্ষ হতে পারব? মানুষ বিশ্বাস করবে?’ কাজী ফিরোজের বিরুদ্ধে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ। 

জাপা সূত্র জানিয়েছে, দলটিকে ফের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসানো এবং জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা বানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। জাপার প্রত্যাশা ৫০ আসন হলেও সংখ্যার বিষয়ে এখনই কিছু বলছে না আওয়ামী লীগ। তাদের সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২টি আসন ছাড়তে পারে সরকারি দল। কিন্তু কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় জাপাকে আসন ছাড়া হবে, তা নিশ্চিত করছে না ক্ষমতাসীনরা। সব আসনে নৌকার প্রার্থী থাকলেও ‘ম্যাচ ফিক্সিং’ করে কিছু আসনে জাপাকে জেতানো হবে– ধারণা দেওয়া হয়েছে। তবে এতে জাপা প্রার্থীরা রাজি নন। তারা চান, যেসব আসন জাপাকে ছাড়া হবে, সেখানে নৌকার প্রার্থী থাকতে পারবেন না। থাকতে পারবেন না স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতারাও। এসব চাওয়া পূরণ না হওয়ায় সমঝোতার চেষ্টার কথা স্বীকার করছে না জাপা। 

দলটির এক কো-চেয়ারম্যান বলেন, সাংগঠনিক শক্তি ও ভোটের অঙ্কে বহু পিছিয়ে থাকায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোথাও পেরে ওঠা অসম্ভব। আসন না পেলে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথা বলেছেন এ নেতা। জাপা সূত্রগুলো জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শেষ অবস্থান দেখতে চান জি এম কাদের। সে কারণেই আওয়ামী লীগ সমঝোতা আলোচনার দিনক্ষণ বললেও, জাপা প্রকাশ্য বৈঠকের জন্য সময় নিচ্ছে। 

জাপার এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে জাপার পক্ষে দু-তিনটি আসন পাওয়াও কঠিন। আবার সমঝোতা করলে আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সবাইকে শত্রু করে, দলের তৃণমূলের নেতাদের মতামতের বিরুদ্ধে নির্বাচনে যাচ্ছে জাপা। আওয়ামী লীগ যদি প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন না ছাড়ে, তাহলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাপা। নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে আওয়ামী লীগ অনিচ্ছা সত্ত্বেও জাপাকে কিছু আসন ছাড়বে বলে ধারণা করছেন এ নেতা। 

শরিকদের হিস্যা কমছে
২০১৪ সালে শরিক এবং মিত্রদের ৫৩ আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। গত নির্বাচনে দিয়েছিল ৩৯ আসন। বিএনপিবিহীন আগামী নির্বাচনে ২০১৪ সালের আড়াই গুণ ২৯ দল অংশ নিচ্ছে। কথিত আছে, বিএনপি নেতাদের ভাগিয়ে নির্বাচনে আনতে গড়ে ওঠা কিংস পার্টিগুলোও রয়েছে নির্বাচনে। তাঁদের প্রার্থী হওয়া বিএনপির সাবেক নেতারাও আসন চাইছেন।
একই চাওয়া নিয়ে গতকাল আমির হোসেন আমুর সঙ্গে তাঁর ইস্কাটনের বাসায় বৈঠক করেন ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, শরিক দলের নেতারা আরও দু-তিনটি করে আসনে ছাড় চেয়েও সাড়া পাননি। বিষয়গুলো সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বলে জানিয়ে দিয়েছেন ১৪ দলের সমন্বয়ক। তবে ছাড় দেওয়া আসনগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরিয়ে নিয়ে শরিক দলের প্রার্থীকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনের সুযোগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু সেসব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেননি। 

এর আগে সোমবার রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকেও আসন কমিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত ছিল। শরিকদের সঙ্গে আসন সমন্বয়ে আমির হোসেন আমু, ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কাকে কয়টি আসন দেওয়া হচ্ছে
গত নির্বাচনে ১৪ দলের চার শরিককে ১০টি আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। ওয়ার্কার্স পার্টির জেতা তিনটি আসন হচ্ছে ঢাকা-৮, রাজশাহী-২ ও সাতক্ষীরা-১। জাসদের আসন তিনটি কুষ্টিয়া-২, ফেনী-১ ও বগুড়া-৪। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পিরোজপুর-২ ও তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসনের এমপি। সূত্র জানিয়েছে, তাদের দু’জনের আবারও জোটের প্রার্থী হওয়া নিশ্চিত। রাশেদ খান মেননকে ঢাকা-৮ থেকে সরিয়ে বরিশাল-৩ আসনে জোটের প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরদার খালেদ হোসেন স্বপনকে সরিয়ে নেওয়া হবে। হাসানুল হক ইনুকে আগেই কুষ্টিয়া-২ আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশাকে রাজশাহী-২ আসনে নৌকার প্রার্থী করার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানিয়েছে, ফেনী-১ আসনে শিরীন আখতারকে আর জোটের প্রার্থী করা হবে না। আওয়ামী লীগের আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী নির্বাচন করবেন। মঙ্গলবারের বৈঠকের সময় শিরীন আখতার তাঁকে ফের প্রার্থী করার অনুরোধ করেন। আমু জানিয়ে দেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু করা যাবে না। সাতক্ষীরা-১ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এবং বগুড়া-৪ আসনে জাসদের রেজাউল করিম তানসেনও জোটের মনোনয়ন পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ সূত্র।

রাশেদ খান মেনন সমকালকে বলেন, বর্তমান তিন এমপির সঙ্গে আরও দু-তিনটি আসনে ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেছি। দেখা যাক, কী হয়। ওয়ার্কার্স পার্টির তিন এমপির কাউকে বাদ দেওয়া হবে বলে মনে হয় না।

হাসানুল হক ইনু বলেন, ১৪ দলের সমন্বয়কের সঙ্গে বৈঠকে চা খাওয়া আর গল্পগুজব ছাড়া কিছু হয়নি। শিরীন আখতার ও রেজাউল করিম তানসেন মনোনয়ন পাচ্ছেন না– এমন তথ্যের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

জোটের আসন বণ্টন ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে: আমু
আমির হোসেন আমু সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন জোটগতভাবেই হবে। ১৪ দল আদর্শিক জোট। আসনবিন্যাসের ওপর জোটের সম্পর্ক নির্ভর করে না। বুধবার জাতীয় পার্টির সঙ্গে আলোচনা করবে আওয়ামী লীগ। আর জোটের আসনবিন্যাস ও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
হাসানুল হক ইনু বলেন, ১৪ দলের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করবেন। যে আসনে জোটের প্রার্থী আসবে, সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী উঠে যাবে। যে কোনো লেনদেনে দরকষাকষি ও মনকষাকষি হবে। বন্ধুদের মধ্যে দরকষাকষি হয়, মনকষাকষি হয়। তাহলে শেষ বিচারে হাসিমুখে উঠে যাব।

জাপা ধোঁয়াশা রাখছে
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের মতো আসন সমঝোতা নিয়েও ধোঁয়াশা রাখছে জাপা। গতকাল বনানী কার্যালয়ে দলের মহাসচিব জানান, দেশে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোট বেশি। ২৭২ আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী রয়েছেন। ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে পারলে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জিতে সরকার গঠন করবে।
বিএনপির ভোট বর্জন প্রসঙ্গে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নির্বাচন অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। বিএনপি তাদের টেকনিকে চলে। জাতীয় পার্টির নিজস্ব কৌশল রয়েছে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) জোরালোভাবে আশ্বস্ত করেছে– ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন। এই আশ্বাসে নির্বাচনে যাচ্ছি। ১৮ ডিসেম্বরের পর মাঠে যাব। তখন বুঝব, অবস্থা কী।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button