শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে মেডিক্যাল শিক্ষা
নিজেদের স্বার্থে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা, নেই কোনো নীতিমালা ও শর্ত :: ৪২ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি :: সাড়ে সাত হাজারের পদোন্নতি সম্ভব
পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে বাংলাদেশের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজ ধুঁকছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি শতাধিক মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে। এর বাইরে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অনেক উচ্চশিক্ষা ইনস্টিটিউশন রয়েছে, এর সবই প্রয়োজনীয় শিক্ষক সঙ্কটে আছে। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ৪২ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি। বিগত দিনে নিজেদের স্বার্থে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া হয়েছে, স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে; কিন্তু শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে প্রায় সব মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষক স্বল্পতায় অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ঠিকমতো চালাতে পারছে না।
গত ৬/৭ বছরে যেসব মেডিক্যাল কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই নেই ন্যূনতম শিক্ষক। ইতোমধ্যে এসব মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ শুরু করেছে। কিন্তু হাসপাতালে এসব নবীন চিকিৎসক দরকারি প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন না। অসম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁদের ইন্টার্নশিপও শেষ হবে। প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়াই একদল চিকিৎসক দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুক্ত হতে যাচ্ছেন। এদিকে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার কোনো নীতিমালা নেই। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিজের জায়গায় নিজস্ব ভবনে মেডিক্যাল কলেজ, কলেজের আয়তন, শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরিÑ এ রকম আরও অনেক বিষয়ে শর্ত আরোপ করা হয়। শর্ত পূরণ করে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজের জন্য কোনো শর্ত নেই। সরকারে থাকা ব্যক্তির ইচ্ছায় এসব মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এদিকে দেশে মেডিক্যাল কলেজ ১১০টি। এর মধ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আছে ৩৭টি, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ৬৭টি, আর্মি মেডিক্যাল কলেজ ৫টি ও আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজ ১টি। সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর মধ্যে নিজস্ব ভবন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়া চলছে ছয়টি মেডিক্যাল কলেজ। চাঁদপুর মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও এই তালিকায় আছে নেত্রকোনা, নওগাঁ, নীলফামারী, মাগুরা ও সুনামগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ। সুনামগঞ্জ ছাড়া এই মেডিক্যাল কলেজগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮ সালে। ২০২০ সালে হয়েছে সুনামগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ।
দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের প্রায় সব মেডিক্যাল কলেজ তীব্র শিক্ষক-সংকটের মধ্যে আছে। পর্যাপ্ত শিক্ষক ছাড়া যথাযথ পাঠদান ও পাঠ গ্রহণ সম্ভব না। যথাযথ পাঠ গ্রহণ ছাড়াই প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষ করে চিকিৎসকের পেশাজীবন শুরু করছেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৪২ শতাংশ শিক্ষকের পদ খালি। অথচ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো বাদ দিলেও কেবল সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, মেডিক্যাল উচ্চশিক্ষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে পদায়ন করার জন্য সাত হাজার ৫৪৭ জন চিকিৎসক রয়েছেন, যারা ইতোমধ্যে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারী অধ্যাপকের স্কেলে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পদোন্নতি দিয়ে মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো হলে সরকারি খাত থেকে নতুন করে কোনো অর্থ ছাড় করতে হবে না।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো: সাইদুর রহমানের স্বাক্ষরিত একটি নোট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার/স্বাস্থ্য সার্ভিসে কর্মরত চিকিৎসকদের পদোন্নতি প্রদানের লক্ষ্যে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে সুপারনিউমেরারি পদ সৃজনের অনুরোধ করে তিনি নোট পাঠান।
সরকারি তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে মোট ৫৬টি সরকারি মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজ ৩৭টি, ১৮টি বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং একটি ডেন্টাল কলেজ রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকের অভাবে মানসম্মত ও গুণগত চিকিৎসাশিক্ষা যেমন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না; এসব মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবগুলোর সাথে রয়েছে জনসাধারণকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য হাসপাতাল। হাসপাতালেও সিনিয়র চিকিৎসকের অভাবে গুণগত মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। চিকিৎসা শিক্ষার প্রাণ হিসেবে এসব মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপরোক্ত তিন পদের চিকিৎসকরা অভিজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবেও চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো: সাইদুর রহমানের নোট থেকেই দেখা যাচ্ছে, এসব মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদ সৃজন না হওয়ায় স্বাস্থ্য ক্যাডারের বিপুলসংখ্যক উচ্চতর বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী হওয়া সত্ত্বেও এসব মেধাবী চিকিৎসকদের অনেকেই মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে অবসরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পদোন্নতির সুযোগ না পাওয়ায় মেধাবী এসব চিকিৎসক সামাজিক ও মানসিক হতাশায় ভুগছেন এবং বঞ্চনার ফলে কর্মস্পৃহা কমে যাচ্ছে। ফলে চিকিৎসা শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রক্রিয়া ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার ও সার্ভিসের ৩৭ হাজার ৭৭৩টি পদের বিপরীতে সহকারী অধ্যাপকের তিন হাজার ৩৮টি, সহযোগী অধ্যাপকের এক হাজার ৯৬০টি এবং অধ্যাপকের এক হাজার ৫৯টি পদ রয়েছে। বিগত বছরগুলোতে ২০টি নতুন মেডিক্যাল কলেজ ও মেডিক্যাল কলেজের সাথে হাসপাতাল স্থাপন করা হলেও তাতে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ তৈরি করা হয়নি। বিসিএসের অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা নির্ধারিত সময়ে পদোন্নতি পেলেও স্বাস্থ্য ক্যাডারের উচ্চতর বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও সময় মতো পদোন্নতি না পেয়ে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
জানা গেছে, পদের অভাবে স্বাস্থ্য ক্যাডারের অথবা সার্ভিসের পদোন্নতি দীর্ঘ দিন বিলম্বিত হওয়ায় ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার ৩৯ জন সহকারী অধ্যাপক, এক হাজার ৬৭৮ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ৮৩০ জন অধ্যাপকসহ মোট পাঁচ হাজার ৫৪৭ জন চিকিৎসকের বেতন স্কেল পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়ে গেছে। ফলে তাদের পদোন্নতি দেয়া হলে সরকারি খাত থেকে অতিরিক্ত কোনো অর্থ ছাড় করতে হবে না। চিকিৎসা শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, বিপুলসংখ্যক রোগীর বিশেষায়িত সেবা প্রদান এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল সেবা নিশ্চিতকরণ এবং তাদের সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি এবং মানসিক ও পদোন্নতি বঞ্চনা নিরসনে সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, সঠিক শিক্ষা ও হাসপাতালে হাতে-কলমে দক্ষতা বাড়াতে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক দরকার। শিক্ষক-স্বল্পতার অর্থ অচ্ছে, সঠিক শিক্ষা না পাওয়া, দক্ষ হয়ে না ওঠা। এর পরিণতি হচ্ছে, ঠিক চিকিৎসা দিতে না-পারা বা ঠিক চিকিৎসা না পাওয়া। এটাই এখনকার বাস্তবতা।