শিক্ষা ডুবিয়ে নিজেও ডুবলেন
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন একাদশ জাতীয় সংসদে কুড়িগ্রাম-৪ আসনের (রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলা) এমপি। তার মন্ত্রণালয়ে পূর্ণমন্ত্রী না থাকায় তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। পাঁচ বছরে প্রাথমিক শিক্ষার তেমন উন্নতি না হলেও তিনি কাজকর্মে ও কথাবার্তায় ছিলেন বিতর্কিত। আর তার পরিবার এলাকায় গড়েছে সম্পদের পাহাড়।
প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী সুরাইয়া সুলতানা রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙা ইউনিয়নে সরকারের পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করলেও পাঁচ বছরে তাকে কেউ অফিসে দেখেননি। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার নানা তদবির নিয়েই গত পাঁচ বছর ব্যস্ত ছিলেন। বেশিরভাগ সময় ঢাকায় কাটিয়েছেন। এমনকি মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকা ফাইলের কাজ প্রতিমন্ত্রীর বাসায় গেলেই হয়ে যেত বলে জানিয়েছেন অনেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকের বদলি, নিয়োগ প্রভৃতিতে আর্থিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ও বিতর্কিত কর্মকা-ের কারণেই জাকির হোসেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকেও ডুবিয়েছেন, নিজেও ডুবেছেন।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলায় প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। রৌমারীর জন্দিরকান্দায় রয়েছে একটি অটো রাইস মিল, তবে এখনো চালু হয়নি। এর পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। পট্টিমারী বাজারে প্রায় ২০ কাঠা জমিতে একটি মার্কেট নির্মাণের কাজ চলছে। রৌমারী বাজারে ১২ শতাংশ জমিতে ছয়তলা একটি ভবন আছে। এর প্রথম ও দ্বিতীয়তলায় মার্কেট এবং ওপরের তলাগুলোতে আবাসিক ভবন।
রাজীবপুর উপজেলায় পোস্ট অফিস রোডে বড় জায়গা দখল করেছে প্রতিমন্ত্রীর পরিবার। জানা গেছে, যেখানে আগে পুকুর ছিল, যার একাংশ খাস। রৌমারীর তুরা রোডে (স্থলবন্দর রোড) একটি তিনতলা ভবন করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকার অনেক খাসজমি প্রতিমন্ত্রীর পরিবারের দখলে।
প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের একাধিক চাচাতো ভাই ও ভাতিজা একেকজন এলাকার হর্তাকর্তা। তারাই আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে প্রাথমিকের বদলি, নিয়োগ প্রভৃতি কাজ করেন। বিশেষ করে প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই রাশেদুল ইসলাম রাশেদ, বাবু মন্ডল, মোয়াজ্জেম হোসেন মাসুম, মোস্তাফিজুর রহমান রবি ও ভাতিজা নূর মোহাম্মদ লিটন এসব লেনদেনের সঙ্গে জড়িত।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষার তেমন উন্নতি করতে না পারলেও নিজ পরিবারের উন্নয়ন করেছেন। সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে নিয়মিত না এলেও মন্ত্রিত্ব উপভোগ করেছেন ঠিকই। প্রাথমিকের বদলি সচিবালয় ঘুরে না হলেও তার বাসা পর্যন্ত কেউ পৌঁছতে পারলে ঠিকই হয়ে যেত। অনেকেই তার স্ত্রী ও চাচাতো ভাই-ভাতিজাদের সঙ্গে বদলিসহ নানা তদবিরের বিষয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত।
সূত্র জানায়, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন মো. জাকির হোসেন। তখন তার ও তার পরিবারের বিত্ত তেমন একটা ছিল না। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে গত পাঁচ বছরে প্রাথমিক শিক্ষার কতটুকু উন্নয়ন করেছেন জানতে এ প্রতিবেদক একাধিক জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। মেয়াদকালে ৩৭ হাজার সহকারী শিক্ষক নিয়োগ কেউ কেউ সাফল্য বললেও অনেকেই বলেছেন, এটা তার রুটিন ওয়ার্ক। সাম্প্রতিককালে অনলাইন বদলি চালু হয়েছে তবে অনলাইন বদলির মধ্যেও বড় অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে সরাসরি বদলিও হচ্ছে, যা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ ব্যবস্থার জন্য তার চেয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষার সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খানের অবদানকেই বড় করে দেখেন সংশ্লিষ্টরা।
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। এ লক্ষ্যে প্রায় ৬০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু জাকির হোসেনের মেয়াদে তা তো হয়ইনি, বরং সেগুলো বন্ধের পথে। প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেওয়া হলেও তারা বেতন পান ১১তম গ্রেডে। গত পাঁচ বছরে এ সমস্যার সুরাহা করতে পারেননি তিনি। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
সম্প্রতি সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে প্রাথমিক শিক্ষার চিত্র। বিশেষ করে জাকির হোসেনের মেয়াদের দুরবস্থার চিত্র। গত আগস্টে প্রকাশিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউনিসেফের এক গবেষণায় বলা হয়, তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৬১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। তৃতীয় শ্রেণির ৫১ শতাংশ ও পঞ্চম শ্রেণির ৫০ শতাংশ বাংলায়ও দুর্বল।
গত বছর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) গবেষণায়ও বলা হয়েছিল, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ইংরেজি যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন-অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে প্রায় ১৫ শতাংশ। একই প্রতিষ্ঠানের করা ২০১৩ সালের জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের কাক্সিক্ষত যোগ্যতা কমেছে।
জাকির হোসেন প্রতিমন্ত্রী হয়েই ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজীবপুর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষক সমাবেশে সোনার নৌকা উপহার নেন। শিক্ষকরা টাকা তুলে এ নৌকা তৈরি করেন। উপজেলার প্রধান শিক্ষকরা ১ হাজার ও সহকারী শিক্ষকরা ৫০০ টাকা করে চাঁদা দেন। যদিও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছিল, শিক্ষকদের অনুরোধে সোনার নৌকা গ্রহণ করেই ফেরত দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী।
গত বছর রাজীবপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে বলতে শোনা যায়, “আমরা কায়মনে দোয়া করব বঙ্গবন্ধুকে যেন আল্লাহ ‘জাহান্নামে’র ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়।” যদিও সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংশোধন করে ‘জান্নাত’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার এ বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় তিনি বেশ বেকায়দায় পড়েন।
এ বছরের শুরুতে জাকির হোসেন বেশ বিতর্কের জন্ম দেন। পুত্র সাফায়াত বিন জাকিরের (সৌরভ) বৌভাতের দাওয়াত পালনের জন্য রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী উপজেলার ২৬৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এবারও শিক্ষকদের ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়েছে। শিক্ষকদের প্রায় ৬ লাখ টাকা চাঁদায় বর-বধূকে ফ্রিজ ও স্বর্ণসহ দামি উপহার দেওয়া হয়েছে।
রৌমারী উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক। কারণ বড় জেলাগুলোতে একটি করে পিটিআই আছে। অথচ কুড়িগ্রামে একটি পিটিআই থাকার পরও রৌমারীতে প্রতিমন্ত্রীর ইচ্ছায় আরেকটি পিটিআই করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের চার একর জমির অধিকাংশই তার চাচাতো ভাই ও আত্মীয়স্বজনের বলে জানা গেছে। অভিযোগ, বেশি দামে জমি সরকারের কাছে বেচতেই এ প্রকল্প। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার সময়ে প্রাথমিক শিক্ষার অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছি, অনলাইন বদলি চালু করেছি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগবিধি করেছি। পিটিআইয়ের অনিয়ম দূর করেছি। টেলিফোনে উন্নয়নের এত কথা বলা সম্ভব নয়। অফিসে আসুন, সবিস্তারে জানাব।’
তিনি বলেন, ‘আগে থেকেই আমি সম্পদের মালিক, মন্ত্রী হয়ে করিনি। রৌমারীর মার্কেট আমার নানির সম্পত্তি। সেখানে ভবনের জন্য ব্যাংক ঋণ নিয়েছি। পট্টিমারী বাজারের মার্কেটের রক্ষক আমি। এর মালিক অস্ট্রেলিয়া থাকে, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয়। অটো রাইস মিলের জায়গা ২০০৯ সালে কেনা। আইসিবির সুদবিহীন ঋণ নিয়ে মিলটি করেছি। তুরা রোডের জায়গাও ২০১০ সালে কেনা। সে জায়গা কলেজ করার জন্য দিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমাকে মাদক কারবারি বানানো হয়েছে। আমাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় এলাকায় শোকের ছায়া পড়েছে।’