শিখ নেতা পান্নুকে কেন হত্যা করতে চায় ভারতের মোদী সরকার?
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে যে ভারত থেকে বেরিয়ে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ‘খালিস্তান আন্দোলনে’ থাকা মার্কিন একজন নাগরিককে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে দিল্লি। ওয়াশিংটন জানিয়েছে ভারত সরকারের কর্মকর্তাদের সাথে কাজ করা একজন ভারতীয় নাগরিক একজন খুনিকে প্রায় এক লাখ ডলারে ভাড়া করেছিলো আমেরিকার মাটিতেই ওই শিখ নেতাকে হত্যার জন্য।
যদিও সেটি কার্যকর হয়নি কারণ পরিচয় লুকিয়ে ভাড়া করা খুনি সাজা ওই ব্যক্তি ছিলেন মূলত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট। আর যাকে হত্যার জন্য ওই টার্গেট করা হয়েছিলো তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার দ্বৈত নাগরিক গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নু। মনে করা হয় নিউইয়র্ক ভিত্তিক এই আইনজীবী এক সময় ‘শিখস্ ফর জাস্টিস’ নামে একটি সংগঠনের মুখপাত্র ছিলেন। ওই সংগঠনটি একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র খালিস্তান গঠনের প্রচারাভিযান চালানোর কারণে ভারত সরকার তাদের ২০১৯ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
স্পর্শকাতর অভিযোগ ওঠার পর দিল্লি জানায় তারা আইন লঙ্ঘনের জন্য পান্নুকে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় রেখেছে, কিন্তু তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তারা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেছেন, “নিরাপত্তা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তোলা এই অভিযোগের তদন্ত করতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে”।
কিন্তু কে এই পান্নু এবং ভারতে তিনি বিতর্কিত কেন : শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী এই ব্যক্তি যে ভারতের পছন্দের নন সেটি পরিষ্কার কারণ ২০২০ সালে দিল্লি তাকে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলো। অন্তত দুই ডজন মামলায় তিনি ভারতের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার একজন, যার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও আছে। এমনকি গত সেপ্টেম্বরে অমৃতসর ও চণ্ডীগড়ে তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে সরকার।
পান্নু অবশ্য তার বিরুদ্ধে তোলা ভারত সরকারের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন তিনি শুধুমাত্র ‘খালিস্তানে’ বিশ্বাস করা একজন অধিকার কর্মী মাত্র। শিখরা ভারতের সংখ্যালঘু এবং দেশটির জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ এ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে ভারত নিষ্ঠুরভাবে শিখ বিদ্রোহ দমন করেছিলো। যদিও শিখদের একটি অংশ এখনো খালিস্তান প্রচারণায় চালিয়ে যাচ্ছে। মি. পান্নু ও এসএফজে (শিখস ফর জাস্টিস) তারই সক্রিয় সমর্থক।
পাঞ্জাবের নাথু চাক গ্রামে জন্ম নেয়া তরুণ পান্নু পরিবারের সঙ্গে পরে চলে এসেছিলেন অমৃতসরের খানকোত গ্রামে। লুধিয়ানার স্কুলে পড়ার পর চণ্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলেন নব্বইয়ের দশকে। ওই সময়ে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন বলে পাঞ্জাব পুলিশের সাবেক একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। সেখানে খালিস্তানপন্থী শ্লোগান দেয়া নিয়ে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিলো। পরে অবশ্য তিনি ওই অভিযোগ থেকে মুক্তি পান।
অনেক বছর পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সেখানে ব্যবস্থাপনা ও আইনে ডিগ্রি নেয়ার পর বিজনেস কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন।
২০০৭ সালে এসএফজে গঠন করা হয়েছিলো মূলত ১৯৮৪ সালে ভারতে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত শিখদের বিষয়টি মাথায় রেখে। তবে পান্নু দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেন ২০২১ সালের পর যখন পরিচিত ভারতীয় রাজনীতিকরা যখনই যুক্তরাষ্ট্র সফর করছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে তার সংগঠন শিখদের বিরুদ্ধে পরিচালিত দাঙ্গায় ভূমিকা রাখার অভিযোগ এনে মামলা করতে শুরু করে।
তিনি ১৭৮৯ সালের একটি আইনের ওপর ভিত্তি করে মামলাগুলো করছিলেন যেখানে বলা আছে বিশ্বের যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হোক না কেন, তার বিচার আমেরিকার আদালতে হতে পারে। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর যখন তিনি নিউইয়র্কে চিকিৎসাধীন ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধেও মামলা করে এসএফজে।
আবার মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান তখন সিং পান্নু-এর বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আলোচনায় আসেন বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চনের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং বচ্চনের বিরুদ্ধে শিখ বিরোধী দাঙ্গাকে উস্কে দেয়ার অভিযোগ আনেন। বচ্চন এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এসব মামলাগুলো পান্নুকে আলোচনায় নিয়ে আসে এবং এর মাধ্যমে তার ভারত বিরোধী প্রচারণাও জোরদার হয়।
ওই বছরেই খালিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য শিখদের বৈশ্বিক গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেন তিনি। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত শিখরা এমন ভোটে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াতেও এমন একটি ইভেন্টের আয়োজনের পরিকল্পনার কথা তাদের ওয়েবসাইটে বলা আছে। `ভারত সরকার ও মোদী আমাকে হত্যা করতে চায়। তারা বৈশ্বিক খালিস্তান গণভোট প্রচারণা থেকে আমাকে সরিয়ে দিতে চায়,’ সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি বলছিলেন টাইম ম্যাগাজিনকে।
এসএফজের ওয়েবসাইটে শত শত ভিডিও আছে যেখানে পান্নু খালিস্তান বিষয়ে কিংবা খালিস্তানের পতাকা তুলে ধরতে নানা উদ্দীপনাময় কথা বলেছেন। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যে তিনি কানাডার হিন্দুদের ভারতে ফিরে যেতে বলছেন এবং বলছেন তিনি “ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিবেন”। সেপ্টেম্বরে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে তিনি বলেন, “দিল্লি হবে খালিস্তান”।
এর আগে তিনি কানাডার নিহত শিখ নেতা হরদ্বীপ সিং নিজ্জারের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেন। ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য কানাডা দিল্লিকে অভিযুক্ত করেছে। তবে ভারত সেই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মাসে ১৯ নভেম্বরের আগে পরে বা ওইদিন তিনি শিখদের এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে না ওঠার জন্য সতর্ক করে বলেন ‘সেখানে জীবনের প্রতি হুমকি থাকতে পারে’।
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছেন মি. পান্নুর সব ‘অপরাধ’ সম্পর্কে ওয়াশিংটনকে অবহিত করা হয়েছে যে তিনি কিভাবে ভারত ও ভারতীয় কূটনীতিকদের ‘হুমকি’ দিয়ে আসছিলেন। সবশেষ এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও, যেখানে তিনি বিদেশে বসে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।