Bangladesh

শিল্প-কারখানায় গ্যাসসংকট: উৎপাদনে ভাটা, বিপাকে অর্থনীতি

* কমছে শিল্পের উৎপাদন, বাড়ছে ব্যয় * প্রভাব পড়তে শুরু করেছে রপ্তানিতে * দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান নিয়েও

সরকারের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনলেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (শিল্প-কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ) উৎপাদন করতে পারছেন না বড় ও মাঝারি শিল্প-কারখানার মালিকরা। ফলে কারখানাগুলোর উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর শিল্প এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। দীর্ঘদিন ধরে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সংকট চলছে।

উৎপাদন অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় গ্যাস না পেয়ে সরকারের কাছে ধরনাও দিচ্ছেন শিল্প-কারখানার মালিকরা। প্রতিবছর শীত মৌসুমে শিল্পে গ্যাসসংকট কিছুটা কম থাকে। কারণ শীতে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের ব্যবহারও কম হয়।

সেই গ্যাস শিল্পে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এবার ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেও শীত না পড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা কমছে না। ফলে কেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার কমছে না। আর সংকটে পড়েছে শিল্প-কারখানা।

দেশে পাইপলাইনে সরবরাহ করা মোট গ্যাসের প্রায় ৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বোরো মৌসুমের চাহিদার কথা মাথায় রেখে সার কারখানাগুলোর উৎপাদন ঠিক রাখতে সেখানেও গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ ঢাকার আশপাশের এলাকায়, বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে।

রাজধানীর অনেক এলাকায় বাসাবাড়িতেও গ্যাসসংকট চলছে। গ্যাসের চাপ না থাকায় ঢাকার আশপাশের সিএনজি স্টেশনগুলো দিনের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে মার্কিন কম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির ভাসমান এলএনজি টার্মিনালনটির মেরামতকাজ চলছে। আমদানি করা এলএনজির একটি অংশ এই টার্মিনাল দিয়ে জাতীয় সরবরাহ লাইনে যুক্ত হয়। পেট্রোবাংলা বলছে, চলমান সংকটে এই মেরামতকাজ কোনো প্রভাব ফেলছে না। তবে দ্রুত গ্যাস সমস্যা সামাধানে কোনো আশার বার্তাও দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা চার হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গতকাল সোমবার পেট্রোবাংলা সরবরাহ করেছে দুই হাজার ৪৮১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ঘাটতি ছিল এক হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। স্বাভাবিক সময়ে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত সর্বোচ্চ তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।

গ্যাসের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে নিজস্ব ৪০টি কারখানায় উৎপাদন করে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় এই গ্রুপের তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল আছে।

মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের উৎপাদনমুখী ৪০টি কারখানার মধ্যে গ্যাসসংকটের কারণে ২০টি বেশির ভাগ সময়ে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। দৈনিক ১৫ হাজার টনের উৎপাদনক্ষম কারখানাগুলোতে এখন মাত্র এক হাজার ৫০০ টন উৎপাদন হয়। চারটি পেপার মিলের মধ্যে মাত্র একটি চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে। চারটি সিরামিক ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিট পালাক্রমে চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দ্রুত গ্যাসসংকটের সমাধান না করলে কারখানা চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। এই সংকট দীর্ঘ হলে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিক-কর্মচারীরা বেকার হয়ে যাবেন।

তৈরি পোশাক শিল্প

দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প। এই শিল্পে ক্যাপটিভ পাওয়ার, বয়লার ও ওয়াশিং প্লান্টের জন্য গ্যাসের দরকার। কিন্তু গ্যাসসংকটে পণ্য উৎপাদনের ডেডলাইন পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে কারখানাগুলো।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমানে পোশাক খাতের উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার নিটওয়্যার রপ্তানিকারকরা গ্যাসসংকটের মধ্যে আছেন। বর্তমানে তা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সোনারগাঁর কাঁচপুরসহ কয়েকটি পোশাক কারখানা ঘুরে কারখানাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। 

আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি দিলীপ কুমার মণ্ডল জানান, দেশের প্রধান রপ্তানি খাত নিট গার্মেন্টসের বেশির ভাগই নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত। ১৪৭টির মতো ডায়িং এবং প্রায় ৪২০টি নিট কারখানায় কাজ করছেন ১৫ লাখ শ্রমিক। মাসে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার নিট পণ্য রপ্তানি হয় এই কারখানাগুলো থেকে। কিন্তু গ্যাসসংকটের কারণে এই হিসাব অনেকটাই নিম্নমুখী।

ফারিহা নিট গার্মেন্টসের বয়লার ইনচার্জ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এই গার্মেন্টসে সাড়ে পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তিন মাস ধরে গ্যাসসংকট। যে কারণে বয়লার চালাতে পারছি না।’

আইএফএস টেক্সওয়্যার লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক এ এম এ জাবেদ বলেন, গ্যাস নেই, অতিরিক্ত খরচে ডিজেল কিনে কারখানা চালাতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সময়মতো মালাপত্র শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না।

বিকেএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আহমেদ বলেন, ‘নিট গার্মেন্টসে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে আমরা মন্ত্রণালয়, বাপেক্স, তিতাসসহ বিভিন্ন সংস্থায় ধরনা দিয়েছি। নিট শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে অবিলম্বে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়েছে।’

সিরামিক শিল্প

সিরামিক খাতের বড় ধরনের ৭০টির বেশি কারখানা গ্যাসসংকটে ভুগছে। দেশের বাজারেও চাহিদা ও সময়মতো টাইলস ক্রেতাদের দিতে পারছে না তারা। মালিকরা বলছেন, এখন ছয় থেকে আট ঘণ্টা গ্যাসের প্রেসার পাওয়া যায়। 

বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, সিরামিক উৎপাদনে মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশই হয় গ্যাসের জন্য। গ্যাসসংকটে বর্তমানে পণ্য উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিদেশি ক্রয়াদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

ইস্পাত কারখানায় উৎপাদনে ধস

ইস্পাত কারখানাগুলোতে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান মালিকরা। এ কারণে রডের মূল্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

কেএসআরএম স্টিল প্লান্টের মহাব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমাদের কারখানায় আগে দৈনিক উৎপাদন ছিল ২০ হাজার টনের বেশি। এখন উৎপাদন ৬০০ থেকে ৮০০ টনে নেমে এসেছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় বিকল্প হিসেবে তেল ব্যবহার করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে।’

কাঁচপুর রহিম স্টিলের ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘গ্যাসসংকটে উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমরা প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ লোকসান দিতে বাধ্য হচ্ছি। উৎপাদন কমে যাওয়ায় রডের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রেতারাও বিরূপ হচ্ছেন।’

পেপার মিল

বসুন্ধরা পেপার মিলের ইউনিট-৩-এর হেড অব প্রজেক্ট প্রকৌশলী আবু হাসান বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ চাহিদা ৫০ মেগাওয়াট। আমরা ৫০টি গ্যাসচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুতের এই চাহিদা মেটাই। কিন্তু গ্যাসসংকটে এখন হিমশিম খাচ্ছি। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সময়মতো বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে পারছি না।’ তিনি বলেন, গ্যাসের সংকট দূর না হলে ধীরে ধীরে কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি আছে।

গ্যাসের চাপ নেই সিএনজি ফিলিং স্টেশনে

ফিলিং স্টেশনের মেশিনে প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ কিউবিক মিটার গ্যাস পাওয়ার কথা। সেখানে পাওয়া যায় মাত্র ১৬০ থেকে ১৭০ কিউবিক মিটার। পেসার ১৫ পিএসআই পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় দুই থেকে পাঁচ পিএসআই।

বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভারশন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নুর জামান জানান, সারা দেশে তাঁদের সমিতির আওতাধীন পাঁচ শতাধিক সিএনজি ফিলিং স্টেশন আছে। এর ৮০ শতাংশ স্টেশনেই গ্যাসের চাপ নেই। তাই দিনের বেশির ভাগ সময় বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আবার সরকারি নির্দেশে রাত ৮টার পর গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়। মালিকরা লোকসান দিতে দিতে ক্লান্ত।

গাজীপুরেও একই চিত্র

গাজীপুর থেকে শরীফ আহমেদ শামীম জানান, গাজীপুরে ৯১৫টি শিল্প, ৫২৮টি ক্যাপটিভ, ২৫৮টি বাণিজ্যিক, ৭০টি সিএনজি স্টেশন ও ৮০ হাজার আবাসিক গ্রাহকের প্রতিদিনের গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ঘন ফুট। পাওয়া যাচ্ছে ৩৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট। এর প্রভাব পড়েছে শিল্প-কারখানার উৎপাদনে। বিকল্প উপায়ে উৎপাদন চালু রাখতে গিয়ে বাড়তি খরচ হচ্ছে।

প্রসাধনসামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজীপুর মহানগরীর জরুন এলাকার কেয়া কসমেটিকসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শওকত আলম বলেন, গ্যাসসংকটে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ভর্তুকি দিয়ে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং ভেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে। তিনি জানান, প্রায়ই পিক আওয়ারে (দুপুরে) গ্যাসের চাপ কমে গেলে একসঙ্গে সব মেশিন চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। অর্ধেকের বেশি মেশিন বন্ধ রাখতে হয়।

শুধু কেয়া কসমেটিকস নয়, গাজীপুরের কোনাবাড়ী, জরুন, কাশিমপুর, বাংলাবাজার, তিন সড়ক, বোর্ড বাজার, ভোগড়া, টঙ্গী শিল্প এলাকার চিত্রও একই রকম।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির গাজীপুর আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের চন্দ্রা বিক্রয় অফিসের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোস্তফা মাহবুব বলেন, আগে চাহিদার ৭০ শতাংশ গ্যাস পাওয়া যেত। দুই মাস ধরে আরো ১০ শতাংশ কমে গেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d