Bangladesh

শীতের শহরেই কম্বল কম

গেল বছর শীতে যখন মানুষ জবুথবু, তখন হুঁশ ফিরেছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের। সে সময় দরপত্র দিয়েও কেনা যায়নি কম্বল। এবার আর শামুকগতিতে হাঁটেনি অধিদপ্তর। আগেভাগেই জেলায় জেলায় পৌঁছে দিয়েছে শীতবস্ত্র। তবে বিভাগওয়ারি কম্বল বিন্যাস নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। বরাদ্দের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট জেলার তাপমাত্রা। যে জেলায় প্রতি বছর শীত জেঁকে বসে, সেখানে কম্বল গেছে কম। যেসব স্থানে ঠান্ডা খানিকটা কম, সেখানে বরাদ্দ মিলেছে বেশি। এ কারণে শীতপ্রবণ এলাকায় কম্বলের জন্য দেখা দিয়েছে হাহাকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীতকবলিত জনপদে কতজন মানুষের ঠান্ডা মোকাবিলা করার মতো পোশাক আছে, সে সমীক্ষা না করেই কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুই সপ্তাহ আগে দেশের আট বিভাগে পৌঁছে যায় ২২ লাখ ৬ হাজার ৭০০ পিস কম্বল। তবে তা চাহিদার চেয়ে অনেকটাই কম। কোথাও এক লাখ হতদরিদ্র মানুষের বিপরীতে কম্বল বরাদ্দ হয়েছে ১৮ হাজারের মতো। অনেক জেলায় প্রশাসন কম্বল হাতে পেলেও শীতার্তদের মধ্যে বিতরণই শুরু করেনি।

শীতপ্রবণ এলাকায় বরাদ্দ কম

পঞ্চগড়ে গতকাল সোমবারও দিনভর মেলেনি সূর্যের দেখা। রাতে পড়ছে বৃষ্টির মতো কুয়াশা। জেলার তেঁতুলিয়ায় গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরের হিমেল বাতাসের সঙ্গে নেমে আসছে হাড়কাঁপানো শীত। বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। হতদরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের গরম কাপড় নেই। এ পরিস্থিতিতে পঞ্চগড়ে সরকারের পাঠানো কম্বল অনেক শীতার্তকে তুষ্ট করতে পারেনি। পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলা ও দুই পৌরসভায় দুই লাখেরও বেশি পরিবার দুস্থ ও হতদরিদ্র। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে ১৮ হাজার ৮৫০ পিস কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার তেঁতুলিয়া উপজেলায় কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে শুধু ৩ হাজার ৭৭০টি। সাত ইউনিয়নের প্রতিটিতে বরাদ্দ হয়েছে ৫৩৮টি। ১ লাখ ২৫ হাজার জনসংখ্যার তেঁতুলিয়ায় এত কম কম্বল নিয়ে মহা বিপদে পড়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, তেঁতুলিয়ার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। শীতের কাপড় কেনার মতো সামর্থ্য তাদের নেই। তীব্র শীত পড়ায় দুস্থ লোকজন কম্বলের জন্য ইউপি কার্যালয়ে ভিড় করছে। তাদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না যে সরকারি বরাদ্দ নেই।

শুধু পঞ্চগড় নয়, উত্তরের মানুষের বড় অংশ তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেন। শীতবস্ত্র কেনা বা জোগাড় করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এক হিসাব অনুযায়ী, রংপুর বিভাগের প্রতি জেলায় হতদরিদ্র শীতার্ত মানুষের সংখ্যা গড়ে তিন লাখের মতো। ফলে রংপুরের আট জেলায় কমপক্ষে ২০ লাখের বেশি হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে। তবে রংপুর বিভাগে কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ পিস।

অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০ পিস, ময়মসিংহ বিভাগের চার জেলায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ পিস, সিলেট বিভাগে চার জেলায় ১ লাখ ৬৩ হাজার ৯৫০ পিস, ঢাকা বিভাগে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৫০ পিস, খুলনা বিভাগে ২ লাখ ৬৫ হাজার ২৫০ পিস, বরিশাল বিভাগে ১ লাখ ৭০ হাজার ৫৫০ পিস, চট্টগ্রাম বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ পিস কম্বল। সবচেয়ে শীতপ্রবণ এলাকা পঞ্চগড়ে ১৮ হাজার ৮৫০ পিস কম্বলের বিপরীতে তাপপ্রবণ এলাকা কক্সবাজারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৭৫০ পিস। 

বরাদ্দ দেওয়া হলেও হয়নি বিতরণ

কুড়িগ্রামে বরাদ্দের ৩১ হাজার ১৫০ পিস কম্বল দেড় সপ্তাহ আগে উপজেলায় উপজেলায় পৌঁছে গেলেও শুরু হয়নি বিতরণ। ৯ উপজেলার ৭৩টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভার জন্য ভাগে কম্বল পড়েছে মাত্র ৪১০টি। তবে সেই কম্বলও না পাওয়ায় শীতে কাবু হয়ে পড়েছে দুর্গম চরের মানুষ। গতকাল রাজারহাটে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীত নিবারণে জেলা প্রশাসন থেকে এক সপ্তাহ আগে কম্বল বরাদ্দ দেওয়া হলেও সেগুলো ফেলে রাখা হয়েছে গোডাউনে। এখনও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিতরণ করা হয়নি। 

সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান ও যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মিয়া জানান, শীতে মানুষ কাঁপলেও এখনও প্রশাসন থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে শীতবস্ত্র সরবরাহ করা হয়নি। একই কথা জানান উলিপুরের আলগা ইউপি চেয়ারম্যান মোজাফফর হোসেন ও বেগমগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া। তারা জানান, শীতের কারণে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে দুস্থ শীতার্ত মানুষের চাপ বাড়ছে। এ ব্যাপারে উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউর রহমান জানান, সামনে নির্বাচন। সে বিষয়টি আমাদের খেয়াল রাখতে হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে বিতরণ করালে আচরণবিধি ভঙ্গ হতে পারে, তাই আমরা বিধিমালা মেনে বিতরণ করব। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, নানা কারণে বিতরণ করা যায়নি। আমরা দ্রুতই বিতরণ শুরু করব। 

রাজধানীতে এত ছিন্নমূল মানুষ, কম্বল অল্প

খোদ রাজধানীতেও বহু ছিন্নমূল মানুষ শীতে কাঁপছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত ১২ ডিসেম্বর ৩০ হাজার ৭৫০টি কম্বল বরাদ্দ দিয়েছে। একই তারিখে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনও বরাদ্দ দেয় ২০ হাজার ৫২০টি কম্বল। চাহিদার চেয়ে সিটি করপোরেশন থেকে খুবই সামান্য কম্বল পেয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলররা। অনেকেই সরকারি বরাদ্দের শীতবস্ত্র না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (ত্রাণ) মো. নূরুল হক চৌধুরী বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কম্বল পরিবহনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল হবে। তবে এর মধ্যে কম্বল পৌঁছে গেছে, বিতরণও শুরু হয়েছে। যেসব এলাকায় বিতরণ শুরু হয়নি, সেসব এলাকায় খোঁজ নেব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, বেশ কিছু দিন আগেই জেলায় জেলায় কম্বল পাঠানো হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা এসব কম্বল বিতরণ করেছেন। এবার কম্বলের মান অনেক ভালো। আমি নিজেই কম্বল বিতরণ তাদারক করছি, খোঁজখরব রাখছি। সব জেলাতেই বিতরণ হয়ে গেছে। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে দ্রুত বিতরণের নির্দেশ দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে পর্যাপ্ত কম্বল আছে, কোনো ঘাটতি নেই। যখন যেখানে যা লাগছে সঙ্গে সঙ্গে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই জেলা থেকে আসা চাহিদা অনুযায়ী কম্বলের বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। তাপমাত্রা অনুযায়ী কম্বল বরাদ্দের বিষয়টি আমরা দেখছি। যেখানে বেশি শীত পড়বে পরবর্তী সময়ে সেখানেই বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button