Bangladesh

শুধু আইন করে রাজনৈতিক ধারা বদলানো কঠিন

এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না কিংবা সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী হলে দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না—সংস্কার কমিশনের এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে দলগুলোর নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন আনতে না পারলে রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তন তো হবেই না, বরং ‘পরিবারতন্ত্র’ আরো পাকাপোক্ত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাই শুধু আইন বা সংবিধান সংশোধন করে বিদ্যমান রাজনৈতিক ধারা বদল করা যাবে না। 

সংস্কার কমিশনের এই দুই সুপারিশ ঘিরে রাজনৈতিক দল, সুধীসমাজসহ বিভিন্ন মহলের আলোচনায় এমন অভিমত উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বেশির ভাগই বলছেন, ক্ষমতার বাস্তবতা ভিন্ন। ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক দলগুলো এই পরিবর্তন আসলেই আনবে কি না তা বলা কঠিন।

বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গতি-প্রকৃতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন এমন কয়েকজন পর্যবেক্ষক কালের কণ্ঠকে বলেন, মূলত পরিবারতন্ত্র থেকে বের হওয়ার লক্ষ্য থেকে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের মধ্যে উপলব্ধি না এলে তা কখনো বাস্তবায়িত হবে না।

উদাহরণ হিসেবে ওয়ান-ইলেভেন-পরবর্তী ঘটনার কথা উল্লেখ করেন তাঁরা। ওই সময় দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন তখনকার কুশীলবরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবায়দা নাসরীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি দল যখন ক্ষমতাচ্যুত হয় তখন একজন নেতা দলের ও সরকারের প্রধান হলে ওই দল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। সেই দিক থেকে দলের প্রধান ও সরকারপ্রধান আলাদা হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক।

আবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি তাতে সরকার ও দলের প্রধান আলাদা করার বিধান থাকলেও দেখা যাবে এক পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই ওই পদগুলো থাকছে।’  

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক বলেন, ‘দুই পরিবারের বাইরে গিয়ে রাজনীতি সম্ভব নয়—এমন ধারণা থেকে দলগুলোর নীতিনির্ধারকরাই তাঁদের নেতা কিংবা নেত্রীকে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখেন। দলের নেতারাই পরিবারতন্ত্র বন্দোবস্তকে আরো সুদৃঢ় করার প্রস্তাব দেন। দীর্ঘদিন ধরে এই ধারা চলে আসছে এবং এখান থেকে বের হয়ে আসার মানসিকতা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’

অবশ্য ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানে যে পরিবর্তনগুলো চেয়েছিল, তার বেশির ভাগই স্থান পেয়েছে সরকার গঠিত কমিশনের সুপারিশে।

তবে সংবিধানের মূলনীতি, সংসদের কাঠামোগত পরিবর্তনসহ সব কিছু যে রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ামতো হয়েছে, তা নয়। অনেক ক্ষেত্রেই দলগুলোর মূল প্রস্তাব ঠিক রেখে তার সঙ্গে আরো কিছু যুক্ত করে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার পথকে আরো সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু পরিবারতন্ত্রের জন্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই বংশপরম্পরায় ওই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনেক ছোট দলের নেতৃত্বেও আছেন শুধু পরিবারের সদস্যরা।  

রাজনৈতিক বোদ্ধা ও প্রবীণ রাজনীতিকরা মনে করেন, এক ব্যক্তি দুইবার প্রধানমন্ত্রী না হলে তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী হবেন। আবার দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রী কিংবা সংসদ নেতা হতে না পারলে তাঁর পরিবারের কেউ হতে পারবেন। তিনি বলেন, প্রধান দুই দলের প্রধানরা সর্বেসর্বা। তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দলীয় গঠনতন্ত্র তাঁদের সেই ক্ষমতা দিয়েছে। তাই শুধু আইন করে রাজনীতিতে কাউকে বাইরে রাখার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে না। 

অবশ্য ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার সুপারিশকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচকভাবে দেখছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি পরিবর্তনের সুপারিশ নিয়ে কোনো কোনো দলের প্রশ্ন রয়েছে। যদিও বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো গতকাল পর্যন্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।

বিএনপিদলীয় সংবিধান সংস্কারবিষয়ক কমিটির সদস্য ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, এসব বিষয়ে বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে। তাই তাঁরা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে তারপর দলের অবস্থান তুলে ধরবেন।

তবে দলটির গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন, এটা চূড়ান্ত কিছু নয়, কমিশনের প্রস্তাব। সরকার রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে যখন সংলাপের আয়োজন করবে, তখন সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে মতামত দেওয়া হবে। তা ছাড়া এগুলো পরবর্তী সংসদ পাস না করলে তা কার্যকর হবে না। সুতরাং কার কি দুরভিসন্ধি আছে, সেগুলোও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকবে।

ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, দলের প্রধান সরকারপ্রধান হতে পারবেন না বলে যে সুপারিশ করা হয়েছে তা ইতিবাচক। দলের প্রধান সরকারপ্রধান হলে ওই দলই সরকার চালায়। তবে এটি শুধু আইন করে করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাকে এই আইনের চেতনাকে ধারণ করতে হবে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বিষয়গুলো অনেকটুকুই আপেক্ষিক এবং নির্ভর করে আগামী দিনে নির্বাচিত সরকার এসব সংস্কার কতটুকু বহাল রাখবেন, তার ওপর! যেহেতু সংবিধান সংশোধনের সুযোগ থাকে, অতএব যে যার সুবিধামতো আবার পরিবর্তন করে নিলে, সেই পরিবারতন্ত্র আবার ফিরে আসতেই পারে।’

তিনি বলেন, ‘দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা না হলে পরিবারতন্ত্র  থেকে বের হওয়া কঠিনই হবে। নেতৃত্বের গুণগত পরিবর্তন, শুদ্ধ দেশপ্রেম, অন্ধ অনুসরণ বাদ দিয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলার প্রক্রিয়া, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভেতরে সততা ও মানবিকতা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে আত্মশুদ্ধি ও সঠিক নেতৃত্ব-মূল্য দেওয়ার প্রবণতা তৈরি না হলে শুধু কাগজের পরিবর্তন দিয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা কঠিন।’

অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কার প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে সুপারিশের সারসংক্ষেপ কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

বিএনপি গত নভেম্বরে সংবিধান সংস্কার কমিশনে গিয়ে ৬২টি প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার বিধান করা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ তৈরি করা, সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের অধীন রাখা, গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তন করা, প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য।

এর আগে ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বিএনপি সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এই ৩১ দফা রূপরেখাকে দলীয় ‘প্রতিশ্রুতি’ উল্লেখ করে বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেয়, তারা নির্বাচিত হলে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করবে। রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের এই ৩১ দফার মধ্যে সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত আটটি প্রস্তাব রয়েছে।

বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতও গত ৮ অক্টোবর ১০ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছিলেন, তাঁদের সংস্কার প্রস্তাব মূলত ৪১ দফা এবং সেটা বিস্তারিত। এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য যেগুলো প্রাধান্য দেওয়া দরকার, শুধু সেগুলোই তাঁরা দিয়েছেন। পরে সংবিধান সংস্কার কমিশনে জামায়াত নিজেদের লিখিত প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন সংবিধান সংস্কারে কোনো দফা দেয়নি। তারা একটি আদর্শ রাষ্ট্রের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, তার একটি বর্ণনা দিয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d