শূন্য থেকে শুরু করে অতিধনী হয়েছেন যে ১০ বিলিয়নেয়ার
ক্লাউন বা ভাঁড় সেজেও বিলিয়নেয়ার হওয়া যায়— কেই বা জানতো। কিন্তু তাই যেন করে দেখালেন গাই ল্যালিবার্ট। তবে জীবনের শুরুটা তাঁর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই গেছে।
কেউ বিশ্বাস করেন নিয়তিতে, কেউবা নিজ চেষ্টায় গড়েন ভাগ্য। সম্পদের বেলাতেও একই বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে সব সময়েই এমন কিছু মানুষ ছিলেন ও আজও আছেন— যারা জীবনের প্রথম দিকের অভাব-অনটনকে পেছনে ফেলে বিত্তের শীর্ষে পৌঁছেছেন। তাঁদের পথচলার এই গল্পগুলো অনুপ্রেরণারও হতে পারে। নিতান্ত সাধারণ অবস্থা থেকে যারা সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেছেন, এমন ১০ জন শতকোটি ডলারের অধিকারী বা তারও বেশি সম্পদশালীদের কথাই এখানে তুলে ধরা হলো।
গাই ল্যালিবার্ট, সম্পদমূল্য: ১২০ কোটি ডলার
ক্লাউন বা ভাঁড় সেজেও বিলিয়নেয়ার হওয়া যায়— কেই বা জানতো। কিন্তু তাই যেন করে দেখালেন গাই ল্যালিবার্ট। তবে জীবনের শুরুটা তাঁর সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই গেছে। প্রথমে কানাডার রাস্তাঘাটে পারফর্ম করতেন, পরে কাজ নেন একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধে। কিন্তু বিপত্তি সেখানেও তাঁর পিছু ছাড়ল না। একবার সেখানকার কর্মীরা করলেন ধর্মঘট। আয়-রোজগার বন্ধ দেখে নিরুপায় হয়ে সেখানে চাকরিতে ইস্তফা দিতে হলো ল্যালিবার্টকে। ফিরলেন আবার সেই স্ট্রিট পারফর্মারের পেশাতেই।
১৯৮৪ সালে কিছু সহকর্মীকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘সার্ক দু সোলেই’। শুরুতে মাত্র এক বছর মেয়াদি উদ্যোগ হিসেবে এটি যাত্রা শুরু করলেও— অচিরেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি ও সমাদর পায় তাদের সার্কাসের আয়োজন। আজ এটি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ সার্কাস আয়োজক ও বিনোদন কোম্পানি। ২০২০ সালে কোম্পানিতে তাঁর সব শেয়ার বিক্রি করে দেন ল্যালিবার্ট, সেখান থেকে পান বিপুল অর্থ। বর্তমানে তাঁর সম্পদমূল্য ১২০ কোটি ডলার।
জে কে রাউলিং, সম্পদমূল্য: ১০০ কোটি ডলার
সাহিত্যপ্রেমীদের মধ্যে জে কে রাউলিংয়ের নাম শোনেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। দুনিয়ার প্রথম বিলিয়নেয়ার লেখক হয়েছেন এই নারী। আর এই সম্পদ এনে দিয়েছে তাঁর লেখা হ্যারি পটার সিরিজের তুমুল জনপ্রিয় বইগুলো।
১৯৯৭ সালে জে কে রাউলিংয়ের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তার আগে কিন্তু তুলনামূলক দরিদ্র অবস্থাতেই কেটেছে তাঁর জীবন। ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল শোক আর বিষাদের ভার। মায়ের মৃত্যু ও বিবাহ বিচ্ছেদের ধাক্কা গভীর ছাপ ফেলেছিল তাঁর মধ্যে।
একা মা হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে সপ্তাহে মাত্র ৬৯ পাউন্ড ভাতা পেতেন তখন। পরবর্তীতে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, আধুনিক ব্রিটেনে গৃহহীন না হয়ে যতটা দরিদ্র হওয়া যায়— আমি তখন ঠিক তাই-ই ছিলাম। তবে দারিদ্র্য ও শোকের ভার নিয়েও কলম হাতে জাদু দেখান রাউলিং। রাতারাতি বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে হ্যারি পটার। এরপর আর তাঁকে পিছু ফিরে দেখতে হয়নি। রাউলিংয়ের লেখাকে উপজীব্য করে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে হ্যারি পটারের চলচ্চিত্রগুলোও। এই ফ্র্যাঞ্চাইজি ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ ও ব্যবসাসফল হয়, আর লেখকসত্ত্বার দৌলতে বিলিয়নেয়ার বনে যান রাউলিং।
জে জি, সম্পদমূল্য: ২৫০ কোটি ডলার
গত বছর তাঁকে সর্বকালের সেরা র্যাপার হিসেবে অভিহিত করেছে সঙ্গীত জগতের অভিজাত সাময়িকী বিলবোর্ড ও ভাইব। ব্যবসা ও সঙ্গীতের ক্যারিয়ারের মাধ্যমে ২৫০ কোটি ডলারের সম্পদ অর্জন করেছেন জে জি। কিন্তু যে পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন, তা ছিল নিত্য সংগ্রামের।
তাঁর আসল নাম শন কোরি কার্টার। জন্ম ব্রুকলিনের বেডফোর্ড-স্টুভেসান্ট অঞ্চলে। সরকারি সহায়তায় নির্মিত আবাসনে মায়ের সাথে থাকতেন। একাকি মায়ের জীবনসংগ্রামেই বেড়ে ওঠা শনের।
তবে র্যাপ সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহের শুরু শৈশবেই। ছোট থাকতে থাকতেই র্যাপ গান শুনে তাতে নিজের মতো করে কথা ও ছন্দ বসিয়ে বলতে শুরু করেন। সেই চর্চা তাঁকে পরে বহুদূর নিয়ে গেছে। ১৯৯৮ সালে পান প্রথম বড় সুযোগ, এসময় হিট হয় তাঁর ‘হার্ড নক লাইফ’ গানটি। সেই শুরু— শোবিজের দুনিয়া জে জি খ্যাত শনের তারপর শুধুই সামনে এগিয়ে চলা। র্যাপার হিসেবে অসামান্য সাফল্যময় এক ক্যারিয়ারের মধ্য দিয়ে জে জি’র সম্পদ আজ আকাশচুম্বী।
হাওয়ার্ড শলৎজ, সম্পদমূল্য: ২৯০ কোটি ডলার
স্টারবাকসের সাবেক এই প্রধান নির্বাহীও বড় হয়েছেন ব্রুকলিনের সরকারি আবাসনে। পরিবারের ছিল ভীষণ অর্থ সংকট। অভাবের তাড়নায় একবার ইউনিভার্সিটি অব নর্দার্ন মিশিগানে পড়ার সময় রক্ত বিক্রি করেছিলেন হাওয়ার্ড। এমনকি টাকার অভাবে ছেলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে পারেননি দরিদ্র বাবা-মা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর পর বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেলসম্যানের কাজ করতেন হাওয়ার্ড। এরপর ইউরোপীয় একটি তৈজসপত্র বিক্রয়কারী কোম্পানিতে যোগ দেন। এসময় হাওয়ার্ডের একজন গ্রাহক ছিল সিয়াটলের অখ্যাত এক কফিশপ স্টারবাকস। একটা সময় পরে তাঁদের ব্যবসা কিনে নেন হাওয়ার্ড, এবং বৈশ্বিক এক কফি চেইনশপে রূপান্তর করেন স্টারবাকসকে। যে নামটি এখন সবাই চেনে। বর্তমানে হাওয়ার্ডের সম্পদমূল্য প্রায় ২৯০ কোটি ডলার।
অপরাহ উইনফ্রে, সম্পদমূল্য: ৩০০ কোটি ডলার
অপরাহ উইনফ্রের নামে আজ আটটি প্রাসাদতুল্য ম্যানশন রয়েছে, ওঠাবসা করেন বিখ্যাতজনদের সঙ্গে। এসব দেখেশুনে সহজে বোঝার উপায় নেই—জীবনের শুরুতে তাঁকেও কঠিন সংগ্রামের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির এক দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারে তাঁর জন্ম; বাড়িতে নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। এই জীবন থেকে মুক্তিলাভের শপথ নিয়েছিলেন মনে মনে, সেই চেষ্টার ফলও মিলল। পেয়ে গেলেন টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি বৃত্তি।
কোর্স সম্পন্ন করে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যের প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান টেলিভিশন প্রতিবেদক হন। এরপর একটি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হন, চালু করেন একটি ম্যাগাজিন। আজ অপরাহ উইনফ্রে রয়েছেন খ্যাতির শীর্ষে। বর্তমানে তাঁর সম্পদমূল্য প্রায় ৩০০ কোটি ডলার।
জর্জ সোরস, সম্পদমূল্য: ৬৭০ কোটি ডলার
হেজ ফান্ড ব্যবসা করে ধনকুবের হয়েছেন জর্জ সোরস। এই ব্যবসার শীর্ষ সময়ে তাঁর অর্জন দাঁড়িয়েছিল আড়াই হাজার কোটি ডলারে।
সোরস আজ যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধনী বিনিয়োগকারী, যদিও তাঁর জন্ম হাঙ্গেরির এক ইহুদি পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরির দখল নেয় নাৎসিরা। এ সময় ইহুদিনিধন থেকে বাঁচতে দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মীর আত্মীয় পরিচয় নিতে হয়েছিল তখনকার কিশোর সোরসকে।
১৯৪০-এর দশকের শেষদিকে তিনি পালিয়ে আসেন লন্ডনে; সেখানে টিকে থাকতে রেস্তোরাঁয় ওয়েটার হিসেবে কাজ নেন, একই সঙ্গে করেছেন রেলের মালবাহকের কাজও। সেই আয় দিয়েই বহুকষ্টে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়াশোনা করেন। ১৯৯২ সালে ব্রিটিশ পাউন্ডের শর্ট সেল করে ১০০ কোটি ডলার আয় করেন বলে জানা যায়। আজ তিনি ৬৭০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদের অধিকারী।
স্টিভ বিসকিওত্তি, সম্পদমূল্য: ৬৯০ কোটি ডলার
পেশাদার আমেরিকান ফুটবল দল বাল্টিমোর র্যাভেনসের মালিক হিসেবে আজ যুক্তরাষ্ট্রবাসীর কাছে বেশি পরিচিত স্টিভ বিসকিওত্তি।
তবে তিনি উঠে এসেছেন এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। বিসকিওত্তির বয়স যখন মাত্র ৮ বছর, তখন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাঁর বাবা। তাঁর দাদা কাজ করতেন ফোর্ড কোম্পানির বিক্রয়কর্মী হিসেবে। তিনিই তখন নেন পুরো পরিবারের ভার। কিন্তু, স্বচ্ছল ছিল না পরিবার। তাই কলেজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে ছোটখাট বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে বিসকিওত্তিকে।
স্নাতক সম্পন্ন করার পরে বিসকিওত্তি তাঁর এক কাজিনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যারোটেক নামের কোম্পানি। বাড়ির বেজমেন্টই তখন তাঁদের অফিস; কাজ চালাতেন পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে। এই ব্যবসায় দ্রুতই সাফল্য আসতে থাকে। কালক্রমে এই কোম্পানি পরিণত হয় মাল্টিবিলিয়ন ডলারের অ্যালেগিস গ্রুপে। যার সুবাদে বিসকিওত্তির বর্তমান সম্পদমূল্য ৬৯০ কোটি ডলার।
রকো কমিসো, সম্পদমূল্য: ৭৫০ কোটি ডলার
মাত্র ১২ বছর বয়সে ইতালি থেকে মা-বাবার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে আসেন রকো কমিসো। পরিবারটি তখন ছিল প্রায় কপর্দকশূন্য। তবে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ভালো প্রতিভা থাকায় একটি ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পেরেছিলেন রকো। পরে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বৃত্তিতে পড়াশোনার সুযোগ পান।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ সম্পন্ন করার পরে তৎকালীন চেজ ম্যানহাটন ব্যাংকে যোগদান করেন, এই ব্যাংকই বর্তমানে বিশ্বখ্যাত জেপি মরগ্যান চেজ নামে পরিচিত। ১৯৯৫ সালে রকো মিডিয়াকম নামের একটি কেবল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। আজ ৩০ বছর পরে রকো কমিসোর মোট সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে ৭৫০ কোটি ডলারে।
কেন ল্যাংগন, সম্পদমূল্য: ৮৭০ কোটি ডলার
হোম ডিপো কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও মার্কিন ব্যবসায়ী হাইস্কুলে পড়বার সময়— সেখানকার অধ্যক্ষ তাঁর মা-বাবাকে ডেকে ছেলেকে আর স্কুলে না পাঠানোর পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, এই ধরনের ‘সম্ভাবনাহীন’ সন্তানকে স্কুলে পাঠানো শুধু শুধু অর্থের অপচয়। ভাগ্যিস কেনের মা-বাবা তাতে কান দেননি। বরং ছেলের স্কুলই পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেন। কেনের মা-বাবা দুজনেই ছিলেন ইতালি থেকে আসা অভিবাসী। বাবা ছিলেন প্লাম্বার, মা কাজ করতেন স্থানীয় এক ক্যাফেটেরিয়ায়, তবু সন্তানের পড়াশোনার জন্য শেষ সম্বল বাড়িটাও তাঁরা বন্ধক রেখে অর্থ জোগাড় করেন।
স্কুলে পড়বার সময়ে ছোটখাট অনেক কায়িক শ্রমের কাজ করতে থাকেন কেন ল্যাংগন। পড়াশোনার পাঠ চুকলে যোগ দেন ওয়াল স্ট্রিটের একটি আর্থিক সেবা প্রদানকারী কোম্পানিতে। ১৯৭৮ সালে প্রথম হোম ডিপোতে বিনিয়োগ করেন তিনি। এরপরেরটুকু আজ ইতিহাসের অংশ। সাফল্যের পর সাফল্যের মুখ দেখেছেন তারপর, আজ তাঁর মোট সম্পদমূল্য ৮৭০ কোটি ডলার।