শৃঙ্খলা ফিরছে না ঋণে
সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ ১০ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা বা ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। ব্যাংক খাতে সম্ভাব্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে ৭ লাখ কোটি টাকা। ঋণের সুদহার কয়েক দফা বেড়ে ১৫ শতাংশের বেশি। কার্যকর ব্যবস্থাপনা কৌশলের অভাবে শৃঙ্খলা ফিরছে না ঋণ খাতে। এখনই পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে আগামীতে আরও কঠিন সংকটের মধ্যে পড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। তাঁদের মতে, ঋণ শ্রেণিকরণের ক্ষেত্রে সরকার যে নীতিমালা করেছে, তাতে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হচ্ছেন খেলাপি হতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালায় ব্যবসায়ীদের ব্যাংক সহায়তার পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশও পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীরা বাধ্য হচ্ছেন ঋণখেলাপি হতে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৩২ হাজার ২৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ছিল ১০ লাখ ২০ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ ছিল ৮ লাখ ১২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকারের ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ধারাবাহিকভাবে দেশের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ। যার বড় একটি অংশ পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ওই সময় দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। তবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, ব্যাংক ঋণের মান নির্ধারণে আবারও আন্তর্জাতিক চর্চা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিদ্ধান্ত মোতাবেক, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোনো ঋণ পরিশোধ না করলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন অতিক্রম করলে খেলাপি হয়ে যাবে। আগে এ সুবিধা ছিল ১৮০ দিন। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার কয়েক দফা বাড়ানোর ফলে বর্তমানে সুদ ১৫ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা দেখা করে একাধিকবার জানিয়েছেন বিদ্যমান প্রতিকূল পরিবেশে ব্যবসা করা কঠিন। এভাবে ঋণের সুদহার বাড়তে বাড়তে ২৫ শতাংশ হলে- একসময় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে বলেও জানিয়েছেন তাঁরা। ফলে চলতি মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ কী পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, সেটা কেউ অনুমান করেও বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বর্তমানে দেশের যা অবস্থা, ব্যবসার ক্ষেত্রে বাঁশ আর হারিকেন ছাড়া আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখছি না। অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে যাবে। ৩৪ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করি, এমন টানাপোড়েন আমার পুরো ব্যবসায়িক সময়ে দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি অর্থনৈতিক অস্বস্তি এবং নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। আমাদের ভোক্তাদের আত্মবিশ্বাস খুবই কম। আর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ইনভেস্টরদের (বিনিয়োগকারীদের) নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। এ বিষয়গুলো আমরা আগে থেকেই প্রাইভেট সেক্টর থেকে বলেছি।’ সবশেষ ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সুদহার কমানোর আহ্বান জানান এবং ঋণ শ্রেণিকরণের সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেন।