Hot

শেখ মুজিব বন্দনায় রেলে হরিলুটের উন্নয়ন প্রকল্প

ম্যুরাল-জাদুঘর নির্মাণে কোটি কোটি টাকা লুট, ম্যুরাল নির্মাণ লুটপাটের একটি বড় হাতিয়ার ছিল-ফাওজুল কবির খান, রেলওয়ে উপদেষ্টা

‘শেখ মুজিব’ বন্দনায় সরকারের অন্য সব দপ্তরের চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না বাংলাদেশ রেলওয়ে। বরং শেখ মুজিবের নামে নানা প্রকল্প তৈরি করে লুটপাটে রেলওয়ে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ২০২০-২১ সালে যখন করোনায় ট্রেন চলাচল এক প্রকার বন্ধ তখনও বিভিন্ন স্টেশন, স্টেশন চত্বর, ভবন ঘিরে চলছিল শেখ মুজিবের ম্যুরাল-ভাস্কর্য তৈরির প্রতিযোগিতা। তার জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে শতাধিক রেল স্টেশন ঘিরে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চলে হরিলুটের উন্নয়ন প্রকল্প। ২০২৩ সাল পর্যন্ত অর্ধশত স্টেশনে ‘মুজিব ম্যুরাল-ভাস্কর্য’ তৈরি করা হয়। ওই সময়ের রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজা ও ড. হুমায়ুন কবিরের পরিকল্পনায় দেশের সবকটি রেলওয়ে স্টেশন-স্টেশন চত্বর ও বিশেষ প্রকল্পে শেখ মুজিবের ম্যুরাল-ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলওয়ের দুই অঞ্চলে দুটি বিশেষ কোচে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর’ তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য, এই জাদুঘরসহ লুটপাটের ম্যুরাল-ভাস্কর্য চুরমার করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে শুক্রবার সন্ধ্যায় রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, রেলে উন্নয়নের নামে শুধুই লুটপাট হয়েছে। ম্যুরাল-ভাস্কর্য নির্মাণ ছিল লুটপাটের আরেকটি হাতিয়ার। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা রয়েছে। তদন্তও চলছে। আমরা বিষয়গুলো তদন্তের মাধ্যমে দেখছি। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা সর্বোচ্চ কঠোর। রেল সাধারণ মানুষের সাশ্রয় ও নিরাপদ মাধ্যম। সেবা ও উন্নয়নের নামে লুটপাটকারীদের শাস্তি পেতেই হবে।

২০২৩ সালের আগস্টে রেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম রেলওয়ে সিআরবির সাত রাস্তা মোড়ে শেখ মুজিবের ৫৭ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি ভাস্কর্যের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন ওই সময়ের রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। ওই বছরই পরিকল্পনা নিশ্চিত করা হয়, রেলে এরকম আরও অন্তত ১০টি ৫০ ফুটের বেশি উচ্চতার ভাস্কর্য তৈরি করা হবে। রেলের দুটি বিশেষ প্রকল্প পদ্মা সেতু রেললিংক ও দোহাজারী-কক্সবাজার প্রকল্পে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা খরচ করে একাধিক ‘শেখ মুজিব’ ভাস্কর্য তৈরির সিদ্ধান্তও হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে অপারেশন ও পরিবহণ দপ্তরে কর্মরত ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, স্টেশন, স্টেশন চত্বর কিংবা প্রকল্প ঘিরে শেখ মুজিবের ম্যুরাল-ভাস্কর্যের কোনো সিদ্ধান্তেই তাদের দপ্তরের কাউকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। সব সিদ্ধান্তই নেওয়া হয় রেলপথমন্ত্রী-সচিব ও রেলওয়ে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে। রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ম্যুরাল-ভাস্কর্য স্থাপনে চরম লুটপাট হয়েছে। সবকটি স্টেশন ঘিরে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে লুটপাটের পাহাড় হতো। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, রাজস্ব বরাদ্দ থেকেই ম্যুরাল-ভাস্কর্য নির্মাণ হচ্ছিল। কিন্তু, খোদ রেলপথমন্ত্রী-সচিব এবং রেলওয়ের প্রভাবশালী আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ‘শেখ মুজিব’ বন্দনার নাম করে।

এদিকে যেসব স্টেশনে শেখ মুজিবের ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে লুটপাটের অভিযোগ পদে পদেই। রেলওয়ে অবকাঠামো দপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, বিভিন্ন স্টেশনের দেওয়াল কিংবা স্টেশন চত্বরে শেখ মুজিবের ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে। এসব ম্যুরাল তৈরিতে বরাদ্দকৃত টাকার বাইরেও সমাপ্ত কিংবা চলমান প্রকল্প থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনসহ প্রায় অর্ধশত স্টেশনের প্ল্যাটফরম উঁচুকরণ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির শত অভিযোগ থাকলেও ওই সময়ের রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, সচিব ও একাধিক উপসচিবের নির্দেশনায় সব কিছুই ঢাকা পড়ে যায়। এমন অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার-এমনটা প্রত্যাশা করছেন রেলের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।

রেলওয়ে পরিকল্পনা দপ্তর সূত্র বলছে, শেখ মুজিব বন্দনায় খোদ রেলভবনে প্রায় ৩ কোটি টাকা খরচ করে রূপসজ্জা করা হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কক্ষসহ একাধিক কক্ষে সেই রূপের ঝলক লাগানো হয়েছে। ভবনের সামনের অংশে থাকা বিশাল আকৃতির শেখ মুজিব ম্যুরালসহ, আড্ডাখানা ভেঙে চুরমার করেছেন ওই মন্ত্রণালয়ে থাকা গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পক্ষাবলম্বনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলেন, এখনো শতাধিক স্টেশন ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্টেশনে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। কিন্তু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে ২০০ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। যার অধিকাংশই লুটপাট করা হয়েছে। যেসব স্টেশনে প্ল্যাটফরম উঁচু করা হয়েছে তা শুধু নামেমাত্র। এসব প্রকল্পে দলীয় বিবেচনায় কাজ পেয়েছে সাবেক মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্টরা। প্রকল্পে সম্পৃক্ত ঠিকাদারদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার অনুরোধ করেছেন রেলওয়ে বৈষম্যবিরোধী কমিটির নেতারা।

এদিকে রেলের দুটি বিশেষ কোচে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর’ তৈরি করা হয়। রেলওয়ে যান্ত্রিক প্রকৌশল দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ২-৩ বছর আগ থেকে রেলে মুজিব বন্দনায় আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা। কোচের অভাবে যখন যাত্রী সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে-তখন প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি মিটার ও একটি ব্রডগেজ কোচে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর তৈরি করা হয়। এ দুটি জাদুঘর উদ্বোধনের পরই নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। ওই সময়ে রোলিং স্টকে দায়িত্বরত রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জরুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে এ দুটি জাদুঘর তৈরি করা হয়। এদিকে রেলের আরও ৪টি বিভাগে এমন রেলওয়ে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর তৈরির পরিকল্পনা ছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের।

পূর্বাঞ্চল রেলের পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপে এ অঞ্চলের ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর কোচটি ভেঙে নতুন করে যাত্রীবাহী কোচ তৈরি করা হচ্ছে। কারখানায় দায়িত্বরত এক কর্মকর্তার ভাষ্য, শুধু শেখ মুজিবের নাম করে এ জাদুঘর তৈরি করে কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। কোচটির ভেতর বিতর্কিত উপস্থাপনাসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চার নেতা এবং অন্যদের কোনো অংশই রাখা হয়নি। রেলের বিভিন্ন সেকশনে এক প্রকার জোর করে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের কোচগুলো প্রদর্শনী করা হতো। এখন আমরা এ জাদুঘরটি ভেঙে পুনরায় যাত্রীবাহী কোচ তৈরি করছি। সামনে ঈদ। কোচের বড়ই প্রয়োজন।

পশ্চিমাঞ্চল রেলের সৈয়দপুর কারখানায় অপর ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরটি ভেঙে কোচে পরিণত করা হচ্ছে। কোচের ভেতর যেসব স্থাপনা ছিল সবই ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। কোচটি দ্রুত মেরামত করা হচ্ছে। আগামী ঈদযাত্রায় এ কোচ দিয়ে সাধারণ যাত্রী পরিবহণ করা যাবে-এমন পরিকল্পনায় মেরামত চলছে। রেলের এক শ্রমিক নেতা বলেন, রেলে সব ধরনের ম্যুরাল-ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আওয়ামী শাসকদের মর্জিমাফিক এসব হয়েছিল।

বিশিষ্টজনদের মতে, জনগণের ট্যাক্সের টাকা জনবান্ধব কাজে ব্যয় করা উচিত। কিন্তু রেলেও মুজিব বন্দনায় কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সাবেক রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে জেলে রয়েছেন। রেলের প্রকল্প ঘিরে কোটি কোটি টাকা লুটপাটে সাবেক রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীও জেলহাজতে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন দুর্নীতিবাজ সাবেক রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক, জিল্লুল হাকিম ও ওবায়দুল কাদের। এদের নামে দুদকে মামলা রয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d