Bangladesh

শেখ হাসিনার ‘খুশি’র গচ্চা: আট প্রকল্পে ২১ হাজার কোটি লোপাট!

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের একান্ত কিছু প্রকল্প এখন প্রশ্নবিদ্ধ, যেসব প্রকল্প তাঁকে মহান কিংবা মানবিক বানানোর কাজে ব্যবহার হতো। তবে নিজেকে মানবিক ও মহান বানানোর পেছনে তিনি কখনো খরচ নিয়ে ভাবতেন না। তাই তাঁর একেকটি চাওয়ার মূল্যও অনেক ব্যয়বহুল ছিল। এ রকম অন্তত আটটি প্রকল্পে তিনি হাত খুলে খরচ করেছেন, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

অথচ হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মানুষের কাজে আসছে সামান্যই। আর জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় হলেও তাঁকে খুশি করতে তৎপর ছিলেন তখনকার ডিসি-ইউএনওরাও। তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ বলছে, আশ্রয়ণ ও বেপজা-বেজার আওতায় এসব প্রকল্প এখন অনেকটাই অন্তঃসারশূন্য প্রকল্পে রূপ নিচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডি সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিয় প্রকল্পের নাম আশ্রয়ণ-২। এ প্রকল্পের আওতায় বঙ্গবন্ধুর নামে গৃহহীনদের ঘর দিতে আট হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ যাদের ওই ঘর দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই ওই সব ঘর ব্যবহার করে না। নিম্নমানের কাজের কারণে বেশির ভাগ ঘরই এখন পড়ে নষ্ট হচ্ছে।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে অন্যের জমি দখল করে ডিসি-টিএনওরা গৃহহীনদের ঘর দেওয়ার কাজ করেছেন। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর লোক-দেখানো এই উদ্যোগ জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। শুধু এই প্রকল্পই নয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ রকম আটটি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ, যেখানে ২০ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। প্রচার রয়েছে, অপচয়ের কারণে প্রকল্পগুলো উন্নয়নের সাদা হাতি হিসেবেও গণ্য হচ্ছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে গত নির্বাচনের আগে সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া অভিযোগের সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিশখালী ইউনিয়নের দুধলীর চর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ৪৬টি ঘর নির্মাণ করা হয়।

দুই বছর ধরে সেখানকার ১৪টি ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। ভাড়া নিয়ে সাতটি ঘরে থাকছে অন্যরা। আবার কোনো কোনো ঘরের ভেতরে-বাইরে গবাদি পশু রাখা হচ্ছে।

রাজবাড়ী সদর উপজেলায় আলাদীপুর কলোনিতে ৭৬টি ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। কল্যাণপুর বিলপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৯টি ঘরের মধ্যে কয়েকটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কল্যাণপুর মধ্যপাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ২২টি ঘরের আটটিতে কেউ থাকে না। এ ছাড়া এখানকার কয়েকটি ঘর বিক্রি করা হয়েছে।

আরো অভিযোগ রয়েছে, শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার পূর্ব ডামুড্যা ইউনিয়নের দাইমী চরভয়রা বিলের ভেতর আশ্রয়ণের ২২টি ঘরের মধ্যে পাঁচটিতে মানুষ বসবাস করছে। বাকি ঘরগুলোতে কেউ কেউ পরিবার নিয়ে উঠলেও নানা সমস্যায় থাকতে পারেননি। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৫৬টি পাকা ঘর তিন মাস ধরে জলাবদ্ধ হয়ে আছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, যে জায়গায় ঘরগুলো নির্মিত হয়েছে, সেখানে ১০ বছর আগে নদীর প্রবাহ ছিল।

সিরাজগঞ্জের চৌহালির খাসকাওয়ালিয়ায় তৎকালীন ডিসি ও টিএনও সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতে জোর করে সাধারণ মানুষের জমি দখল করে আশ্রয়ণের ঘর তৈরি করে গৃহহীনদের তুলে দিয়েছেন, যে জমি নিয়ে এখনো কোর্টে মামলা চলছে। একটি জমির মালিক আইনজীবী ফরিদ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিসি ও টিএনও জোর করে আমার দুই বিঘা জমি দখল করেছেন। সেখানে দেড় শতাধিক গাছ কেটে আশ্রয়ণের ঘর তুলেছেন। তাঁরা বলছেন এটি খাসজমি। কিন্তু আমার কাছে জমির সব নথিপত্র আছে। এখানে আমার মতো এমন অনেকেরই জমি অস্ত্রের মুখে দখল করে আশ্রয়ণের ঘর তোলা হয়েছে।’

দেশের অন্য জায়গায়ও এমন চিত্র  রয়েছে। অর্থাৎ আশ্রয়ণের নামে অন্যের জমি দখল করে দেওয়া এই ঘর কোনো কাজেই লাগেনি গরিবদের। বলা যায়, এই প্রকল্পের আট হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা প্রায় জলে গেছে। অথচ নির্বাচনের আগে এই প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে শেখ হাসিনাকে মহান করে দেখিয়ে জনগণের চোখে ধুলা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় জুন ২০২৪ পর্যন্ত সাত হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের কাজ হয়েছে ৮৪ শতাংশ।

এদিকে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর পূর্ব-উত্তর তীরে খুরুশকুলে ২০২০ সালের ২৩ জুলাই প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি পাঁচতলা ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় প্রায় ৬০০ পরিবারের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হয়। ফ্ল্যাটের যাঁরা মালিক হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ জেলে, শুঁটকি শ্রমিক, রিকশা ও ভ্যানচালক, ভিক্ষুকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সেখানে অধিগ্রহণ করা ২৫৩ একর জমিতে গড়ে উঠছে ১৩৭টি পাঁচতলা ভবন। এসব ভবনে ফ্ল্যাট চার হাজার ৩৮৪টি। বিনা মূল্যেই এই ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুরা। প্রকল্পটিতে মোট এক হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ফিরোজ বলেন, এখানে যাঁরা ফ্ল্যাট পেয়েছিলেন তাঁদের বেশির ভাগই এখানে থাকেন না। তাঁদের কাজকর্ম মূলত নাজিরাবাজারে। এত দূর থেকে গিয়ে তাঁদের কাজ করতে অসুবিধা হয়। তাই এখানকার ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে তাঁরা নাজিরাবাজারের আশপাশে থাকেন। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ফ্ল্যাটই এখানে ভাড়া দেওয়া। 

খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের মনখালী নামের ভবনের ২০২ নম্বর ফ্ল্যাট বরাদ্দ পান মোহাম্মদ জাবের। পানিসংকটের কারণে তিনি সেখানে বসবাস না করে বিমানবন্দরসংলগ্ন কুতুবদিয়ায় বসবাস করেন। তিনি বলেন, বরাদ্দ পাওয়া অনেক লোকই সেখানে বসবাস করেন না। একই ভবনের নুরুল হক নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘আমি নিজ খরচে পানির পাম্প বসিয়ে মিষ্টি পানির ব্যবস্থা করে বসবাস করছি নিজ ফ্ল্যাটে। তবে বরাদ্দ দেওয়া ফ্ল্যাটের অনেকগুলোই হাতবদল হয়ে গেছে।’

স্থানীয় ভাড়াটিয়া ও ফ্ল্যাট মালিকদের ভাষ্য মতে, প্রতিটি ফ্ল্যাট আড়াই লাখ থেকে ছয় লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি হচ্ছে। তবে অত্যন্ত গোপনে এবং বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তির নিজের লোকজনের মধ্যেই বেচাকেনার কাজটা হয়েছে। মুক্তা ভবনের ফ্ল্যাট বরাদ্দ পাওয়া জসিম বলেন, ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে বরাদ্দ পাওয়া লোকজন বাইরে থাকে এটা সত্য। তবে বেচাবিক্রির বিষয়টি সংগোপনে হয়ে থাকে বিধায় কতগুলো ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, আশ্রয়ণের ঘরগুলো যেখানে নাগরিক সুবিধা রয়েছে সেখানে করা উচিত ছিল। প্রকল্পে খাসজমি খুঁজে এমন জায়গায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে নেই কোনো সড়ক যোগাযোগ, নেই কোনো কর্মসংস্থান বা কোনো নাগরিক সুবিধা। তাই বিনা টাকার ঘর পেলেও সেখানে মানুষকে রাখা যায়নি।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে যে জনগণের অর্থের অপচয় করা হয়েছে এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি উন্নয়নের নামে, জনকল্যাণের নামে জনগণের অর্থে দুর্নীতির সুযোগ নেওয়া এবং সেটাকে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পে বহুমাত্রিক প্রতারণা ও দুর্নীতি হয়েছে। যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁরা জনগণের অর্থের অপচয় করেছেন। তাঁদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

এদিকে ৯ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের পাঁচটি প্রকল্পে আলোর দিশা নেই। মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে কয়েকটি শিল্প গড়ে উঠলেও মিলছে না শ্রমিক। কারণ আশপাশে কোনো জনবসতি ও আবাসিক অবকাঠামো নেই। নেই সেখানে যাওয়ার মতো পরিবহনব্যবস্থাও। ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে থেকে অফিস করতে হয়, যার যাতায়াত ভাড়াও অনেক। ওখানকার ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলেও একই সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে।

একই অবস্থা মিরসরাইয়ের বেপজা (বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ) অর্থনৈতিক অঞ্চলেরও। সেখানেও এক হাজার ৩০২ কোটি টাকা ব্যয়ে বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকল্পটির ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে শিল্প স্থাপন নিয়েও রয়েছে সংশয়।

বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা কম্পানি খাইশি লিনজেরি ৬০.৮৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। গত ডিসেম্বরে আট হাজার শ্রমিক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও এক হাজারের বেশি কর্মী নিয়োগ দিতে পারেনি। কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন ও পরিবহন সুবিধা না থাকায় এখানে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।

বেপজার এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কেপিএসটি নামের জুতার কাঁচামাল তৈরির একটি কারখানাও উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু তারা এখনো নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী নারী শ্রমিক না পেয়ে চিন্তিত বলে জানা গেছে।

বেজা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ) চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজীতে প্রায় ৩০ হাজার একর উপকূলীয় এলাকাজুড়ে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর তৈরি করছে। অন্যদিকে বেপজা এই শিল্পনগরীর মধ্যে এক হাজার ১৩৮.৫৫ একরের বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করছে। কয়েকটি কারখানা চালু হচ্ছে, যাতে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক অঞ্চলে জায়গা বরাদ্দ পেয়েছেন কিন্তু এখনো কারখানা স্থাপন করেননি, এমন কয়েকজন শিল্প মালিক বলেন, স্থানীয় শ্রমিক পাওয়া না গেলে ৬৫ কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত দেড় ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তাঁদের শ্রমিক পরিবহন করতে হবে। ফেনী ও নোয়াখালীর মতো দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিকদের এখানে আনা-নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হবে বলে জানান তাঁরা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button