শেখ হাসিনা দেশকে আরেকটি গাজায় পরিণত করেছিলেন : ড. ইউনূস

ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখনকার পরিস্থিতির বিবরণ দিতে দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে শেখ হাসিনা দেশকে আরেকটি গাজায় পরিণত করেছিলেন।
ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তখনকার পরিস্থিতির বিবরণ দিতে দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে শেখ হাসিনা দেশকে আরেকটি গাজায় পরিণত করেছিলেন।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা এই মন্তব্য করেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি সোমবার সংবাদমাধ্যমটি প্রকাশ করে।
প্রকাশিত সাক্ষাতকারের ভূমিকায় বলা হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন বাংলাদেশে আসেন, তখন এক বিষণ্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। তখন রাস্তাঘাট ছিল রক্তে ভেজা। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল সহস্রাধিক বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতা। নৃশংসতা থেকে বাদ পড়েনি নিষ্পাপ শিশুরাও।
দীর্ঘ ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এ সময় দেশের হাল ধরেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি নোবেল বিজয়ী
অর্থনীতিবিদ। বহু আগেই রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেছিলেন। তবুও হাসিনা তাকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন। ফলে বছরের পর বছর তাকে হাসিনার নিন্দা ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
যখন ছাত্ররা তাকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিতে আহ্বান জানায়, তিনি এতে রাজি হয়ে দেশে চলে আসেন।
দায়িত্ব নেয়ার সময়কার বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরে ড. ইউনূস গার্ডিয়ানকে বলেন, শেখ হাসিনা যে ক্ষতি করে গেছেন, তা ছিল অভূতপূর্ব ও অপূরণীয়। তখন দেশ ছিল সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত। এ যেন ছিল আরেকটি গাজা। অবশ্য এখানে ভবন ধ্বংস করা হয়নি। ধ্বংস করা হয়েছে সবধরনের প্রতিষ্ঠান, নীতি, মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।
হাসিনার শাসনামল ছিল অত্যাচার, সহিংসতা ও দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। জুলাই ও আগস্ট মাসে তার দমন-পীড়নের শিকার হয়ে ১৪০০ জনের বেশি ছাত্র-জনতা নিহত হয়। এ সময় পুলিশের যে সহিংস দমনপীড়ন ছিল, জাতিসঙ্ঘের মতে তা ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
হাসিনার আমলে জনরোষ ও ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখি পুলিশ সদস্যরা তাদের পদে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক।
এছাড়া দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ঢাকার রাস্তায় গ্যাং অপরাধ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ড. ইউনূস হাসিনার আমলের তুলনায় রাস্তাঘাট কম নিরাপদ বলে তোলা যেকোনো দাবিকেই অস্বীকার করেন। অবশ্য অন্যরা সতর্ক করেছেন যে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি তার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ড. ইউনূসের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকে দেশের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার করা হয়েছে; আয়নাঘর উন্মোচন করা হয়েছে এবং মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ সময় হাসিনা শত শত অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন, যা তিনি অস্বীকার করেন। ড. ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
নতুন জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রধান ছাত্রনেতা নাহিদ ইসলাম গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব।’
ড. ইউনূসকে যদিও এখনো ব্যাপকভাবে সম্মান করা হয়, তবে তার শাসন ক্ষমতা ও প্রতিশ্রুত সংস্কারের গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকেই।
ড. ইউনূস হাসিনার শাসনের পরিণতি হিসেবে দেশের দুর্দশাগুলোকে উপস্থাপন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘হাসিনার শাসনামলে কোনো সরকার ছিল না। সেটা ছিল দস্যু পরিবার। বসের নির্দেশে সব করা হতো। তাদের নীতি ছিল- কেউ সমস্যা তৈরি করছে? তাদের উধাও করে দাও। নির্বাচন করতে চান? আমরা নিশ্চিত করব যে আপনি সব আসনে জয়ী হবেন। আপনি টাকা চান? এখানে ব্যাংক থেকে এক মিলিয়ন ডলার ঋণ নিন। এই টাকা আপনাকে আর ফেরত দিতে হবে না।’
হাসিনার অধীনে পরিচালিত দুর্নীতির মাত্রা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অত্যন্ত নাজুক করে তুলেছে। এতে দেশের অর্থনীতিও ভেঙে পড়েছে। আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া হাসিনার আত্মীয়দের মধ্যে তার ভাগ্নী যুক্তরাজ্যের লেবার এমপি টিউলিপ সিদ্দিকও রয়েছেন। হাসিনার শাসনামলের সাথে জড়িত সম্পদ নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার পর এবং বাংলাদেশে দুর্নীতির তদন্তে নাম আসায় সিদ্দিক ট্রেজারি থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তিনি তার এসব অন্যায় কাজকে অস্বীকার করেছেন।
হাসিনার মিত্রদের দ্বারা দেশের ব্যাংক থেকে নেয়া ১৭ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ উদ্ধারের জন্য যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের আর্থিক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা চলছে। তবে শিগগিরই তা ফেরত পাওয়ার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে।
ড. ইউনূস বলেন, ‘সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণে ব্যাংকগুলোকে জনগণের অর্থ লুট করার পূর্ণ অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বন্দুক হাতে পাঠিয়ে সবকিছু ঠিক করে দিতো।’
ড. ইউনূসের উপর সবচেয়ে বড় চাপ বাংলাদেশের বাইরে থেকে এসেছিল। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন হাসিনা ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নিমিত্তে সেখানে আশ্রয়ে রয়েছে। এতে উভেয় দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ভেঙে যায়। ইউনূস ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারত তাদের সংস্কারে খুব কম আগ্রহ দেখিয়েছে। সম্প্রতি দিল্লি ঢাকাকে ‘উগ্রবাদকে স্বাভাবিক করার’ অভিযোগ করেছেন।