শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি নির্বাচন পর্যন্ত টেনে আনাই বড় ক্ষতির কারণ
বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন শেষে পোশাক শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন। মজুরি বৃদ্ধির খসড়া প্রজ্ঞাপনও জারি হয়েছে। মাঝখানে দেশে-বিদেশে এ খাতের যে আর্থিক ক্ষতি এবং সুনাম নষ্ট হয়েছে তা নিয়ে এখন বিচার-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। এ খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মনে করছেন, বেতন বৃদ্ধির জন্য গঠিত মজুরি বোর্ডের মেয়াদ বাড়িয়ে জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে নিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি।
এটি কয়েক মাস আগেই ফায়সালা করা যেত। তাহলে এত বেশি ক্ষয়ক্ষতি হতো না।
শ্রম আইন অনুসারে পাঁচ বছর পর পোশাক শ্রমিকদের জন্য নতুন মজুরি ঠিক করার কথা। ২০১৮ সালে শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করা হয়।
সে হিসেবে চলতি নভেম্বর মাসে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা। নতুন নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয় গত এপ্রিলে। নভেম্বরে বোর্ডের ছয় মাস মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে মজুরি নির্ধারণের কাজ শেষ করতে না পারায় বোর্ডের মেয়াদ এক মাস বাড়ায় সরকার।
নতুন মজুরি কার্যকর হবে ১ ডিসেম্বর থেকে। গত ৭ নভেম্বর খসড়া মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়। আগামী ১৪ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন হবে। ঘোষিত মজুরি কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়ে রেখেছে।
৫৬ শতাংশের বেশি ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে আট হাজার টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে।
পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর এখন সব পক্ষ ঘটনার পরম্পরা বিচার-বিশ্লেষণ করছে। তাতে মোটা দাগে জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিষয়টিকে টেনে আনাকে ঠিক হয়নি বলে মনে করছে প্রায় সব পক্ষ। তারা বলছে, মজুরি বোর্ডের
মেয়াদ এক মাস বাড়িয়ে নির্বাচনী উত্তেজনার সময়ের মধ্যে টেনে নেওয়া ঠিক হয়নি। এতে মজুরি আন্দোলনে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব পক্ষের গাছাড়া ভাব ও উদাসীনতা এর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার ও মালিকপক্ষ বলছে, সব কিছু নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হয়েছে।
মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, মজুরি ঘোষণা নিয়ে কালক্ষেপণ আর কিছু মালিকের অসাবধানতা ও রাজনৈতিক ইন্দনে পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মজুরি বোর্ডের মেয়াদ ছয় মাসের পর আরো এক মাস টেনে নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। সাধারণ শ্রমিকরা একে কালক্ষেপণ বলে মনে করেছেন। এর মধ্যে নেতিবাচক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা শ্রমিকদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ইন্দন জোগানোরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আর মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মজুরি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হয়েছে। কোনো কালক্ষেপণ হয়নি। ডিসেম্বরের মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি কার্যকর হওয়ার কথা, তা হচ্ছে।
মজুরি আন্দোলনে চারজন শ্রমিক নিহত হওয়াসহ বিশ্বসেরা কয়েকটি কারখানা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অনেক ক্রেতা কার্যাদেশ সাময়িক স্থগিত করার কথা বলেছেন। বিজিএমইএ বলছে, ২৫টি কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে এক হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এই খাতে।
জানতে চাইলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, শ্রমিকরা নায্য দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করবে। জ্বালাও-পোড়াও করার কথা নয়। তারা বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক প্রতারণার কবলে পড়েছে। মজুরি বোর্ডে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মালিকপক্ষ নিম্নতম মজুরি বোর্ডের মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর আবেদন করেছিল। আমরা তা করতে দেইনি। শ্রম আইন অনুসারে চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে মজুরি ঘোষণা করার কথা, তা হয়েছে।’
শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলাকালে কারখানা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ বিভিন্ন অভিযোগে শুধু আশুলিয়া ও সাভারে করা ৪০ মামলায় নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৯৫ জন।
মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আন্দোলনে যারা সহিংসতা করেছে, তারা সুযোগ সন্ধানী। এ সবে সাধারণ শ্রমিকদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। কারণ শ্রমিকরা কখনো লাঠিসোঁটা ও হেলমেট পরে কারখানায় আসেন না। তিনি বলেন, বামপন্থী কিছু কর্মী আর সরকারবিরোধীরা এটা করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতির এই সময়ে মালিক-সরকার-শ্রমিক সব পক্ষ আলাপ-আলোচনা করে এবং আন্তরিকতা দিয়ে এই সংকটের সমাধান করা উচিত। তিনি বলেন, মজুরি বৃদ্ধির সময় হলে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামতে হয়। অতীতে কখনো এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। দর-কষাকষির জায়গায় মালিকদের পাল্লা সব সময় ভারী থাকে। শ্রমিকরা বঞ্চিত অনুভব করেন।
সেলিম রায়হান বলেন, দেশ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপও আছে। চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ অবস্থায় মজুরির বিষয়টি টেনে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত না এনে আরো ছয় মাস আগে এটি চূড়ান্ত করা যেত। তখন মালিক-শ্রমিক কেউই হয়তো এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। আসলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ছয় মাসের বেশি সময় নিয়ে নেওয়া ভুল বার্তা দিয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, নিম্নতম মজুরি বোর্ড নতুন মজুরি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে পারত। এক মাসের বেশি লেগেছে। একে খুব বড় কালক্ষেপণ বলা যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে আগামী মজুরি বোর্ড চার বছরের মাথায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করব. যেন এতে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব না পড়ে।’
সংঘাত এড়ানো যেত কি না জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘হয়তো যেত। জাতীয় রাজনীতি, স্থানীয় রাজনীতি, মূল্যস্ফীতি—সব কিছু মিলিয়ে আন্দোলনে প্রভাব পড়েছে।’