Hot

শ্রমিক অসন্তোষে বন্ধ ১১৯ কারখানা, ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ

শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে পোশাকশিল্প। বিরূপ পরিস্থিতির কারণে আশুলিয়া, সাভার ও টঙ্গীতে সোমবার ১১৯টি কারখানা বন্ধ রাখা হয়। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।

অন্যদিকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন বিদেশি ক্রেতারা, দিচ্ছেন না নতুন অর্ডার। সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানান শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশি ও বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। এ সংকট দ্রুত শক্তভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাকশিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর-আশুলিয়া অঞ্চলে অনন্ত, শারমীন, হা-মীম, স্টারলিং গ্রুপসহ ৬৮টি কারখানা স্ব-বেতনে (লিভ ইউথ পে) বন্ধ রাখে। যেসব কারখানা খোলা ছিল, এর মধ্যে ১৩টি কারখানার শ্রমিকরা কাজ না করে বেরিয়ে যান। এছাড়া ৮টি কারখানা খোলা থাকলেও শ্রমিক ও বহিরাগতরা কাজ বন্ধ করে ভেতরে বিশৃঙ্খলা করেছে। সব মিলিয়ে ১১৯টি কারখানা বন্ধ রাখা হয়।

বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তৈরি পোশাকশিল্প কঠিন সময় অতিক্রম করছে। শ্রমিক অসন্তোষের জেরে একদিকে কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশি ক্রেতারা শীত ও গ্রীষ্মের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছেন। রপ্তানি আদেশ যাতে অন্য দেশে চলে যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবে গার্মেন্টে হামলা, ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রাস্তায় বিক্ষোভ করা হচ্ছে। এ বিক্ষোভের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের দূরতম সম্পর্কও নেই। তিনি আরও বলেন, রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মালিকদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিকনেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হবে।

শ্রমিকদের উদ্দেশে হাতেম বলেন, কারও প্ররোচনায় পড়ে কারখানায় ভাঙচুর চালাবেন না। শ্রমিকদের যে কোনো ন্যায্য দাবি সরকার-শ্রমিক-মালিকরা কারখানার অভ্যন্তরে বসে সমাধানে প্রস্তুত আছে। এসব দাবি কারখানাতেই সমাধান সম্ভব। রাজপথে সমাধান নেই।

বিজিএমইএ-এর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট-এ দুটি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করতে চক্রান্ত শুরু করেছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করতে চাচ্ছে। এ ধরনের দুর্বৃত্তদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। তিনি আরও বলেন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে পোশাক খাতে অর্ডার কমে গেছে। বিদেশি ক্রেতারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের ভরসা দিতে সরকারের তরফ থেকে বার্তা দেওয়া উচিত।

শ্রমিকনেতারা বলছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা তৈরি পোশাকশিল্পকে অস্থিতিশীল করতে ভাঙচুর চালাচ্ছে। শ্রমিক বিক্ষোভের আড়ালে তারা শিল্পকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছে। ভাঙচুরে নিরীহ শ্রমিকরা জড়িত নন, বহিরাগতরাই এসব করছে। যেসব দাবির কথা বলা হচ্ছে, ৫ আগস্টের আগে সেসব দাবির কথা শোনা যায়নি।

দিনভর বিক্ষোভ-কারখানা ভাঙচুর : আশুলিয়া, সাভার ও টঙ্গী এলাকায় বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ নানা দাবিতে কাজ বন্ধ রেখে রাস্তা অবরোধ করেন। সাভারের ইউফোরিয়া অ্যাপারেলস লিমিটেড, নাঈম নিট, ফ্যাশন ডটকম, কন্টিনেন্টাল গার্মেন্টস, মাসকট নিটওয়্যার লি. লুসাকা গ্রুপ, অরুনিমা স্পোর্টস লিমিটেড, অ্যালায়েন্স নিট কম্পোজিট লিমিটেড, মেডলার অ্যাপারেলস লিমিটেড, ইয়োগি বাংলাদেশ লিমিটেড ও পাল গার্মেন্টস লিমিটেডের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। কোথাও আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে কারখানা খোলা রাখা হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আশুলিয়ায় বিভিন্ন কারখানার সামনে রাতেও অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি সড়কে টহল দেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব ও এপিবিএন সদস্যরা।

আশুলিয়ার এস. সুহি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক লিমিটেড কারখানার মানবসম্পদ এবং কমপ্লায়েন্স বিভাগীয় প্রধান সাইফুদ্দিন মিয়া বলেন, একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে দেশের পোশাক খাতকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। যারা বিভিন্ন কায়দায় শিল্পে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে, তারা শ্রমিক না, সবাই বহিরাগত। ৪০-৫০ জন লোক রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন কারখানায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। আমরা শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে কাউন্সেলিং করে কাজে রাখার চেষ্টা করছি। সরকার এবং প্রশাসনেরও উচিত শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন আমাদের কমপক্ষে ৫০ হাজার পিস পোশাক উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। সময়মতো অর্ডারের মালামাল বুঝিয়ে দিতে না পারলে ক্রেতারা আমাদের দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে পোশাক খাতের রপ্তানি অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ অন্য দেশে চলে যাবে। এমন পরিস্থিতি হলে বিশাল জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, অব্যাহত শ্রমিক অসন্তোষের কারণে ৮০-৯০টি কারখানা বন্ধ ছিল। মূলত শ্রমিকদের দাবিগুলোর বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় আগে থেকেই কয়েকটি কারখানায় বন্ধ ও ছুটির নোটিশ টাঙিয়ে দেয়। এছাড়া কিছু কারখানায় শ্রমিকরা কাজ না করায় সেগুলো ছুটি দেওয়া হয়েছে। অন্য কারখানাগুলোয় উৎপাদন চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি মাঠে কাজ করছেন বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

র‌্যাব-৪-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর জালিস মাহমুদ খান বলেন, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের বুঝিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হলেও একপর্যায়ে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তারা র‌্যাবের একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টাসহ ভাঙচুর করেন। সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। আমাদের টিম ছায়াতদন্ত করছে। শিল্পাঞ্চলে যারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে, সেসব দুষ্কৃতকারীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button