সংকট বাড়াচ্ছে ডলার-রিজার্ভ
ডলারের আধিপত্য রুখতে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন দেশ বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যিক লেনদেন করার চেষ্টা করছে। এজন্য আলাদা প্ল্যাটফর্মও গড়ে তোলারও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখনো বিশ্বের বাণিজ্যিক লেনদেনের ৯০ শতাংশই মার্কিন ডলারে সম্পন্ন হয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। দেশের আমদানি বাণিজ্যের বেশিরভাগই ডলারের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে ডলারের সংকটের প্রভাব অর্থনীতিতে প্রকটভাবে দেখা যায়। ডলারের দামের ওপরই এখন নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতি, প্রবাসী আয় ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ।
দুই বছর আগেও মার্কিন ডলার ও রিজার্ভ পরিস্থিতিতে অনেকটা স্বস্তির জায়গায় ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু করোনা-পরবর্তী হঠাৎ চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের মতো অনেক দেশকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে যুক্তরাষ্ট্র সুদহার বাড়ালে বাংলাদেশের মতো দেশের বিপদ আরও বাড়ে। সারা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায়, ডলার আরও শক্তিশালী হয়। অবশ্য বাংলাদেশে ডলার সংকটের ক্ষেত্র তৈরি হয় ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই, ২০২১ সালের শেষ দিকে। তবে যুদ্ধে পর থেকে বিপুল আমদানি ব্যয় ও ঋণ পরিশোধের চাপে সংকট বাড়তে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। চাহিদা ও জোগানে ঘাটতি থাকায় টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য গত দুই বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আর গত ২৫ মাসে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৫৬ শতাংশ কমে গেছে। রিজার্ভের এমন পরিস্থিতিতে সরকার নানা শর্ত মেনে আইএমএফসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ পেতে উদগ্রীব। কিন্তু বৈশ্বিক ঋণ সংকটের এমন সময়ে ঋণপ্রাপ্তিও কঠিন হয়ে পড়েছে।
২০২২ সালে ডলার সংকট প্রকট হয়ে উঠলে খোলাবাজারে প্রথমবারের মতো ডলারের বিপরীতে টাকার দর ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। পাশাপাশি বিলাসী পণ্য আমদানিতে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ করে। এই পদক্ষেপে আমদানি কিছুটা কমেছে। কিন্তু ডলারের সংকট কাটেনি। সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ থেকে প্রতি মাসেই ডলার বিক্রি করেছে। এতে গত এক বছর গড়ে প্রতি মাসে রিজার্ভ কমেছে এক বিলিয়ন ডলার। আর গত সেপ্টেম্বরে ডলারের সংকট আরও বাড়লে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ বাড়ায়। এতে রিজার্ভ থেকে কমে যায় আরও দুই বিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দিয়ে বাণিজ্য ঘাটতি মোকাবিলা করা সম্ভব হলেও ঋণের দায় মেটানো এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ ও সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছে তার কিস্তি পরিশোধ দিন দিন বাড়তে থাকায় ডলারের সংকটও বাড়ছে। ২০২৪ সালে বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলে তা আরও বাড়তে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে দেশের টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৬০ শতাংশ। আর গত দুই বছরই অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ছিল ৬৮ টাকা ৬০ পয়সা। আর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। একই বছর যখন দেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় সে সময় ছিল ৮৪ টাকা ৮১ পয়সা। কিন্তু চলতি বছরের অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
টাকার এই অবমূল্যায়নের জন্য অর্থনীতিবিদরা দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুল নীতিকে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে ডলার বাজারের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এতে ব্যাংকগুলো বেশি দরে ডলার কিনছে না। যার সুযোগ নিচ্ছে অবৈধ ডলার ব্যবসায়ী বা হুন্ডি এজেন্টরা। তারা বেশি দরে ডলার কেনায় প্রবাসীরা অবৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এতে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ডলার আয়ের প্রধান দুটি খাত হচ্ছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। এই দুই খাত থেকে পর্যাপ্ত ডলার না আসায় মূলত বাংলাদেশ চাপের মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মাধ্যমে ডলার আসে, যা সাময়িক। রিজার্ভ ধরে রাখতে হলে বিদেশ থেকে ধার করে এখন সামাল দেওয়া যাবে না। মুদ্রাবিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বিদ্যমান সংকটের সামাল দেওয়া যেতে পারে। এটি আইএমএফের ঋণের শর্তেও রয়েছে।
ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার শর্ত পূরণ না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধিদল। বিশেষ করে রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও আমদানিকারকদের জন্য ভিন্ন পৃথক দর বেঁধে দেওয়া অবাস্তব হিসেবে দেখছে তারা। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক যে দরে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করে, সেটিও বাজারভিত্তিক নয় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফ মনে করে, বাজারভিত্তিক ডলার দর কার্যকর না করায় রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমছে।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৮৪ কোটি (২৬ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন) ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে ২ হাজার ১০৭ কোটি ডলার। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা জনগণের কাছে প্রকাশ না করে শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। আইএমএফ সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে প্রকৃত রিজার্ভ আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে।