Trending

সংকট সময়ের বাজেট ও মানুষের প্রত্যাশা

বাংলাদেশে গেল দেড় দশকে যে কয়জন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন, তার মধ্যে সম্ভবত আবুল মাল আবদুল মুহিত অপেক্ষাকৃত বেশি ভাগ্যবান ছিলেন। এর কারণ তিনি যে কয়টা বাজেট পেশ করেছিলেন, সেই সময়টায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভূ-রাজনীতি, সম্পদের প্রতুলতা ইত্যাদি বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। বস্তুত বড় বাজেট, ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস তাঁর আমলের উপহার। সমালোচকদের ভাষায় ‘উচ্চাভিলাষী’ বাজেট দেওয়ার প্রত্যয় এবং পরিবেশ তখন ছিল।

আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থনীতির হাল ধরার পরপরই বিশ্বব্যাপী করোনার করাল গ্রাস; আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলো বাংলাদেশের অর্থনীতি। অর্থনীতি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলল কিছুদিন। কিন্তু যেই ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এলো, ঠিক তখনই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বেধে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত করে তুলল। বেচারা অর্থমন্ত্রী তাঁর পারদর্শিতা প্রদর্শন করার সময় ও সুযোগটুকু থেকে বঞ্চিত হলেন।

এবার নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এসেছেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি। তিনি এমন এক সময় দায়িত্ব নিলেন, যখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিস্থিতি এবং তার সঙ্গে সর্বশেষ ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ, ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা বৃদ্ধি—সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিল। অর্থনীতির জন্য এমন একটা অস্বস্তিকর এবং পীড়াদায়ক পরিবেশে দেশের নতুন অর্থমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসান মাহমুদ আলী এমপি আসন্ন বাজেট পেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে হয়তো তিনি নতুন, কিন্তু অর্থনীতির শিক্ষক, কূটনীতিক, সংসদ সদস্য এবং পররাষ্ট্র ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক বড়।

কিন্তু ওই যে একটু আগে বললাম, অর্থমন্ত্রীদের জন্য ভাগ্যের ব্যাপারটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে আমরা নতুন অর্থমন্ত্রীর সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি।

দুই.

https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/05.May/10-05-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg

আমরা অবগত যে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন মোটাদাগে তিনটি সমস্যায় আক্রান্ত—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের নাজুকতা। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা মুখ থুবড়ে পড়ার মতো প্রান্তে পৌঁছেছে বললে অতিরঞ্জন হবে না। বর্তমান সরকার এবার ক্ষমতায় এসে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব সূচকে নজর দিতে হবে বলে ভেবেছিল, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি ও প্রবাস আয়, ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বিদেশি ঋণ, রাজস্ব আয় ইত্যাদি।

আরো আশ্বস্ত করা হয়েছিল, দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাদের সহ্যসীমা শূন্য (জিরো টলারেন্স) অর্থাৎ কোনো ধরনের দুর্নীতি বরদাশত করা হবে না। তবে  পরিসংখ্যান বলছে অন্য কথা। ব্যাপক এবং বিস্তৃত দুর্নীতি ও বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচার এবং অপেক্ষাকৃত কম রাজস্ব আয় অর্থনীতির টুঁটি চেপে ধরার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছে। এই আগুনে আবার ঘি ঢালছে বড়মাপের ঋণখেলাপি। অপরদিকে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতির পারদ কিছুতেই যেন নিচে নামছে না, বরং ১০ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থাৎ দুই বছর ধরে একজন দিনমজুর, রিকশাওয়ালা কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত অব্যাহতভাবে ১০০ টাকার জিনিস কিনছে ১১০ টাকায়, তা না হলে ১০০ টাকা দিয়ে ৯০ টাকার পণ্য কিনে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাবারের ক্রমবর্ধমান দাম দেশের ৭১ শতাংশ পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশে এখন মোট পরিবার বা খানার সংখ্যা চার কোটি ১০ লাখ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মানলে, খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা দুই কোটি ৯০ লাখের বেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগের বিষয়। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো সমস্যা অন্যখানেও—তলানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, টাকার মানে ধস ইত্যাদি। এসব সংকট সাপেক্ষে বিভিন্ন উৎসর প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার অন্তত ২০২৩-২৪ বছরে ৬ শতাংশের নিচে থাকবে। এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের আশঙ্কা আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহকে ব্যাহত করে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্তর আরো বাড়িয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সুতরাং সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার নতিজা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে শঙ্কা, উদ্বেগ।

তিন.

গেলবারের তুলনায় অন্তত এবারের বাজেটের আকার প্রান্তিক কম হলে মন্দ হবে বলে মনে হয় না। অথচ করোনার আগ পর্যন্ত মূল বাজেটের আকার বাড়ছিল ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে। মূলত দুটি কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার বড় করা উচিত নয়। প্রথমত, ব্যয় নির্বাহের জন্য অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের অবকাশ কম। এমনিতে অত্যধিক ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছে দেশ, ইদানীং বাকিও পড়ছে; দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতি বা বাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সব ধরনের ব্যয় কমাতে হবে, যখন অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির অন্যতম শক্ত নিয়ামক বলে শনাক্ত করা হয়। সন্দেহ নেই যে বাজেটের আকার হ্রাস পেলে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাবে। তবে আপাতত উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের লাগাম টেনে ধরতে হলে এর বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, মাননীয় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলবেন, কেন অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বাংলাদেশে তা অধরা; বিশেষ করে আমরা জানতে আগ্রহী বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থা কেন যথাযথভাবে কাজ করছে না।

চার.

আগামী বাজেটে আশা করব, খাদ্য উৎপাদন, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষিতে ভর্তুকি এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যথাযথ মনোযোগ দেওয়া হবে। সরকার কর্তৃক দেয় ভর্তুকির  বেশির ভাগ রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা চেটেপুটে খান বলে অভিযোগ আছে। সুতরাং পুরো ভর্তুকিপ্রক্রিয়ার ফোকাসে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি, যাতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠী প্রবেশগম্যতা পায়।

এতদঞ্চলে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম। গবেষকরা বলছেন, করজাল বিস্তৃত করে, আয়কর বাড়িয়ে পরোক্ষ করের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব করা যায়। কয়েক দশক ধরে কর সংস্কারের কথা, ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কথা শুনে আসছি। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি মন্থর কেন, তা জানার অধিকার জনগণের আছে। মন্দ ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলেই কি সমস্যার সমাধান হবে, না দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে গাঁট বেঁধে ভালোত্ব ভুলে যাবে?

রিজার্ভের সমস্যা কাটাতে অবশ্যই বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে, কিন্তু এত পদক্ষেপ নেওয়ার পর কেন বাংলাদেশ ভিয়েতনাম, ভারত, এমনকি মিয়ানমারের চেয়ে অনেক কম এফডিআই আকর্ষণ করে, সে বিষয়ে জানার অপেক্ষায় আছি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন একটি সূত্র ধরে বলছেন এবং জাতিসংঘও এতে একমত যে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার পাচার হয়। তার মানে সাত বিলিয়ন ডলার বা মোট প্রায় চার মাসের রেমিট্যান্স আয়ের সমান। তা ছাড়া ‘বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম’ ইত্যাকার বিষয়ে দুর্বল কণ্ঠে বক্তৃতা-বিবৃতির বদলে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। একজন সাবেক মন্ত্রীর বিদেশে ২৫০টি বাড়ির মালিকানা এবং ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং (রিজার্ভের ১ শতাংশ) দেশান্তরিত হওয়ার যে খবর ব্লুমবার্গ রিপোর্ট দিয়েছে, তার সঙ্গে অন্যান্য মুদ্রা পাচার, করমুক্ত দ্বীপরাষ্ট্রে সম্পদের নোঙর করা বৈদেশিক মুদ্রা ফিরিয়ে আনতে পারলে রিজার্ভ শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈদেশিক রিজার্ভ থেকে জাতীয় সর্বোচ্চ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবে কোনো প্রকল্প নেওয়া সমীচীন নয় বলে মনে করেন এই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। একক বিনিময় হার প্রচলন, যার মধ্যে রেমিট্যান্স প্রণোদনা যুক্ত হয়ে প্রেরকের হাতে পৌঁছবে, এটা নিশ্চিত করতে পারলে কার্ব মার্কেটের কেরামতি কমানো সম্ভব। বিদেশি বাণিজ্য সহযোগীদের সঙ্গে বিনিময় হারের আনুপাতিক ওজন নিয়ে প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার (রিয়াল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট) এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে হারটি কার্ব মার্কেটের হারের কাছাকাছি থাকে। রপ্তানি আয়ের শতকরা ১২ ভাগ বিদেশে থেকে যাচ্ছে বলে প্রকাশ। এটা মোটেও কাম্য নয়—বড়জোর তা ৫ শতাংশ হতে পারে। এ ক্ষেত্রেও বৈদেশিক মুদ্রা হাতছাড়া হচ্ছে। রপ্তানিকারক স্পষ্ট নীতিমালার আওতায় ভিন্ন ভিন্ন খাতে সুনির্দিষ্ট হারে রিটেনশন কোটা পেয়ে থাকেন, তার পরও কেন তাঁরা বিদেশে রপ্তানি আয় পার্ক করবেন প্রশ্ন করেছেন ড. ফরাসউদ্দিন।

পাঁচ.

সারা অঙ্গে ব্যথা, মাননীয় অর্থমন্ত্রী ওষুধ দেবেন কোথা। এক. যথাযথ সুশাসন নিশ্চিত করে দুর্নীতি দূরীকরণ ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হ্রাস বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার আছে বলে দেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যাশা করে। মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় আমরা তার প্রতিফলন দাবি করি। দুই. চোখ-ধাঁধানো ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি দ্রুত বর্ধনশীল দুর্নীতি ও বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এযাবৎকালের সব অর্জন বিসর্জন দিতে হতে পারে। সেই লক্ষ্যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তিন. দুর্নীতি দমন ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য হ্রাসে জাতির কাছে অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকার জন্য একটানা চতুর্থবারের মতো রেকর্ডধারী নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আরো কঠোর এবং নির্মম হতে হবে। চার. এবারের বাজেটে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ও ফলাফল সম্পর্কিত বক্তব্য চাই, এবারের বাজেটে বৈষম্য হ্রাসে সরকারি পদক্ষেপের বিবরণী চাই। এবারের বাজেটে প্রকৃতি প্রদত্ত দাবদাহ থেকে নয়, বাজার প্রদত্ত দাবদাহ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার যথাযথ নীতিমালা চাই।

আমাদের অর্থনীতির এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করব : ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা,/বিপদে আমি না যেন করি ভয়।/দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে/নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,/দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button