সংবিধান নিয়ে ক্ষমতাসীনদের নিষ্ঠা কতটা!
সংবিধান নিয়ে ক্ষমতাসীনদের নিষ্ঠা কতটা! – ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ অর্থাৎ সংবিধান অনুসরণ করা নিয়ে সম্প্রতি সরকারের উপর মহল থেকে যেসব বাণী বচন উচ্চারিত হচ্ছে, তাকে বিবেচনায় নিলে মনে হবে আইন অনুসরণ নিয়ে শাসক দল এতটাই নিষ্ঠাবান, যা কিনা অতুলনীয়, অভূতপূর্ব! কিন্তু বোধ্যা ও সচেতন মহল অবশ্য এ নিয়ে একেবারে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাদের ধারণা ক্ষমতাসীন মহল সময় সুযোগ বুঝে যখন যা বলে, সেটি নিছক পার পাওয়ার জন্যই বলে থাকে। ইদানীং সেটিই অব্যাহত রেখেছে। সংবিধান নিয়ে যে একনিষ্ঠতার কথা শোনানো হচ্ছে, তাকে সামনে রেখে অতীত থেকে এখন অবধি শাসক দলের এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ ও আচার-আচরণ ও সংবিধান অনুসরণের বিষয়টি কোনোভাবেই প্রমাণিত সত্য বলে ধরে নেয়া যায় না। অতীতে সংবিধানকে যে তরিকায় তাদের পূর্বসূরিরা যেভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছেন মাত্র কয়েক মিনিটে, যা শুধু অভাবনীয় নয়। সেটি ছিল একেবারে সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটাই পাল্টে দেয়ার মতো ঘটনা। অথচ এমন পরিবর্তন আনতে হলে জনমত গ্রহণ ছিল একান্ত আবশ্যক। কিন্তু সেটি করা হয়নি। অপর দিকে বৃহত্তর দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত হয়েছিল। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিত যারা রচনা করেছিল; অনুসন্ধানে দেখা যাবে তাদের অন্যতম ছিল আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী সরকারের আমলে ২০১১ সালের ১৫ জুন সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিত করা হয়। এখানে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড যে কথা বলেছিলেন, সেখানে যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছিল, তা ছিল এমন- সংবিধান থেকে কখনো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সরানো হবে না। কিন্তু তার মাত্র ১৫ মাস পরেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিত করে দেয়া হয়। এখন যদি আগের সেই প্রতিশ্রুতির কথা কেউ স্মরণ করে, তবে হয়তো এ কথাই বলা হবে তা ছিল নিছক ‘বাত কা বাত’ বা কথার কথা। এ পরিপ্রেক্ষিতে কেউ যদি এমনও ভাবে বা ধারণা করে, শাসক দল হাওয়ার সাথে তালমিলিয়ে আকাশের মতো ক্ষণে ক্ষণে তাদের রঙ রূপ বদলায়। আরো বলা যায়, হতে পারে যে, শাসক দলের হাইকমান্ডের বক্তব্যের সাথে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী একেবারেই সাংঘর্ষিক। এও যদি কেউ বলে, হাইকমান্ডের প্রতিশ্রুতি ও ১৫তম সংশোধনীর যে বৈপরীত্য সেটি একটা সুবিধা আশ্রয়ী রাজনীতির অনুষঙ্গ। তাহলে তার কী উত্তর হবে।
এ দিকে গত ১৭ জুন ২০২৩ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কবীর বিন আনোয়ার মেহেরপুরে আওয়ামী লীগের স্মার্ট কর্নার লঞ্চিং অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসব বুঝি না, আগামী সংসদ নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধানের প্রতি হঠাৎ এমন আনুগত্য কি অতীতে ক্ষমতাসীনরা কখনো দেখিয়েছেন।
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন যেসব বিষয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, তার কয়েকটি মধ্যে অন্যতম গণতন্ত্রের যথাযথ অনুশীলন তথা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আদর্শিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া জনগণের মৌলিক অধিকারের সাথে সংযুক্ত মানবাধিকারের প্রশ্নটি। বাংলাদেশের সংবিধানে এই দুই প্রশ্নে যা বলা হয়েছে এবং বাস্তবে সরকার তার কতটুকু অনুশীলন করছে ও গত প্রায় ১৫ বছর কিভাবে করেছে তার একটা মূল্যায়ন গ্রহণ করা হলে সবার কাছে এটা পরিষ্কার হবে, তারা কোন দিকে ঝুঁকে আছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রয়েছে, ‘গণতন্ত্র, সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানে গণতন্ত্রের প্রশ্নে আরো বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধার বোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ সংবিধানের প্রস্তাবনা ও সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের সব বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা খুব প্রাসঙ্গিক হবে না বিধায় মাত্র দু-চারটি বিষয় নিয়ে মাঠের বাস্তবতা ও শাসকশ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। যেমন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, শাসনযন্ত্রে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের যে ভূমিকা জনগণ ও বোধ্যা সমাজ সে বিষয়ে কী ভাবছেন তা দেখা যেতে পারে। গণতন্ত্রের হাল অবস্থা এখন কতটা নাজুক সে সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু মাত্র স্পর্শ করে গেলেই যথেষ্ট হবে। প্রথম কথা হচ্ছে, গণতন্ত্রে মূল অনুশীলন হচ্ছে, কতটা সুষ্ঠুভাবে ভোটদান সম্পন্ন হয়। গত দু’টি নির্বাচন অনুষ্ঠানের হাল অবস্থা যা ছিল, তা দেশের সব মানুষের কাছে স্বচ্ছ। কোনোটি ভোটারবিহীন, আবার ২০১৮ সালে দিনের ভোট আগের রাতেই হয়ে গেছে। বিগত দিনের যে দুটো নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা হলো, সেগুলো ছিল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার একটা কূটকৌশল মাত্র। ওই দুই নির্বাচন যে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অধীনে সম্পন্ন হয় সেই কমিশনগুলো ছিল মেরুদণ্ডহীন, ফরমাইশি কমিশন। তাদের করানো নির্বাচন দু’টির কোনোটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সেসব নির্বাচনের ফলাফলের সাথে জনগণের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাই প্রশাসনে নাগরিকদের কার্যকর অংশগ্রহণ কেমন করে হবে। অর্থাৎ যারা তখন সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নির্বাহী হন। তাদের কেউ এমন দাবি করতে পারবেন না, সুষ্ঠু ভোটে বা জনগণের ভোটে তারা পদ-পদবি পেয়েছেন।
এ দিকে অতি সম্প্রতি রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যেভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীন সরকার অত্যন্ত জোর গলায় বলছে, বর্তমান সরকার যে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সক্ষম তা ওই দুই নির্বাচনই প্রমাণ করে। তবে কথা হলো যে, নির্বাচনে কোনো প্রতিপক্ষই ছিল না। তাহলে একে নিয়ে আর কতটা উচ্চবাচ্য করার কী আছে। বর্তমান সরকারের অধীনে ভালো নির্বাচন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তেমন ‘সুষ্ঠু’ নির্বাচন হবে। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনেও যদি কোনো প্রতিপক্ষ না থাকে তবে সেই নির্বাচনের ভবিষ্যৎ কী? সরকারি দলের প্রধান তিন প্রতিপক্ষ পরিষ্কার করেছে, আগামী সংসদের নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তাই এখনই ভবিষ্যতের নির্বাচন ব্যাপারে শেষ কথা বলার অবস্থানে আওয়ামী লীগ কি রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে বলেছে, সংসদে থাকা দলগুলো নিয়ে তাদের নেতৃত্বে নির্বাচনী সরকার হবে। তারা এ পর্যন্ত এতটুকু অবধি নেমে এসেছে, ভবিষ্যতে আর কতদূর কী হয় সেটি ভবিতব্য। তবে আওয়ামী লীগসহ তাদের সহযোগী সবাই মনে করে ভবিষ্যতে ‘ডিজাইন’ মার্কা কোনো নির্বাচন করা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কোনোভাবে সম্ভব হবে না। দেশের ভোটবঞ্চিত মানুষ জেগেছে, সব বিরোধী দল এখন রাজপথে। পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তির অবস্থান এমন, বাংলাদেশে একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন হোক সে প্রশ্নে তারা অটল অবিচল। তাই যেমন তেমন নির্বাচন সহজ হবে না।
অবশ্য ক্ষমতাসীনদের মনোবল এখনো কিছুটা অবশিষ্ট আছে। কেননা রুশ-চীন-ভারত এই তিন শক্তির আশ্বাস তাদের সাথে আছে। আর থাকবেইবা না কেন, রুশ-চীন তাদের দেশে নাগরিকদের স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার কোনো সুযোগই রাখেনি। সে জন্য বাংলাদেশের মানুষের ভোট নিয়ে সেই দুই দেশের কোনো মাথাব্যথার কারণ নেই। আর ভারত এখন যেভাবে গণতন্ত্র মানবাধিকারের অনুশীলন করে চলছে; তাকে অতীত থেকে এখন কিন্তু বিচ্যুত বলা যায়। অপর দিকে, বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতি পশ্চিমের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমর্থন রয়েছে। এখন সরকারি দল যদি ত্রিশক্তির সাথে হাত মিলিয়ে এখানে একটি নির্বাচনী প্রহসন মঞ্চস্থ করতে চায়, তাহলে ইতিহাসের কৃষ্ণ এক অধ্যায়ের সাথে তারা জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু এটাও কি এখন সম্ভব ক্ষমতাসীনরা যা চায় তাই করবে।