Bangladesh

সংসদ নির্বাচনের সঙ্গেই গণভোটের প্রস্তাব

সংবিধান সংশোধনের বৈধতা দিতে নতুন প্রস্তাব পেয়েছে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংস্কার কমিশন। প্রস্তাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে আলাদা ‘হ্যাঁ-না’ ব্যালটে গণভোট আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। যদিও বর্তমান সংবিধানে গণভোটের বিধান নেই।

এ ছাড়া অংশীজনের প্রস্তাবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, নির্বাচনকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া, সংসদের ভোটে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বসহ সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে। সংস্কার কমিশন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

গেল ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের জোর দাবি ওঠে। ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সামাজিক সংগঠনগুলোর তরফ থেকে নানা প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামতও নিচ্ছে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন। রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি পর্যায়ের সুপারিশ কমিশনের ওয়েবসাইট ও ই-মেইলে পাঠানোর সময় আজ সোমবার শেষ হচ্ছে।

এর পাশাপাশি বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে আসছে সংস্কার কমিশন। সূত্র জানায়, অংশীজনের এসব বৈঠকে সংবিধান সংশোধনে বিভিন্ন অনুচ্ছেদের পরিবর্তন এবং পরিমার্জনের প্রস্তাব করার সঙ্গে সংশোধনের প্রক্রিয়া নিয়েও বিভিন্ন মতামত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধানে গণভোটের পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবও রয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরাসরি কমিশন বৈঠকে না বসলেও তাদের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে। 

সংস্কার কমিশনের কাছে এসব প্রস্তাবের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সংসদবিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন আহমদ সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এখন জোরালোভাবে সংস্কারের কথা বললেও তাদের মনোযোগ বেশি নির্বাচনে। অতীত অভিজ্ঞতায় নির্বাচনের পর সংস্কারকাজে রাজনৈতিক দলের আগ্রহ দেখা যায় না। তাই বর্তমান সরকারের উচিত, সংসদের ভোটের আগেই সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্বাচন করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। 

সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটের প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত। তা না হলে এত আন্দোলন, এত রক্ত, এত পরিশ্রম বৃথা যাবে। জনগণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একাধিক ব্যালটে ভোট দিতে অভ্যস্ত। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালটের ব্যবস্থা করা হলে সহজেই সরকার জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে যাবে।

বর্তমান সংবিধানে গণভোটের বিধান নেই– এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন বলেন, আদালতে ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের মামলার শুনানি চলছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত হওয়ার মধ্যে হয়তো আদালতের রায় এসে যাবে। 

তবে তাঁর এই অবস্থানের বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। তাঁর মতে, আদালতের রায় পক্ষে এলেই গণভোট বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে না। তিনি বলেন, ‘এ জন্য জেনারেল ক্লজ, সেকশন-সিক্স অনুযায়ী সংসদের অনুমোদন লাগবে।’ 

এদিকে সংস্কার কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এ সপ্তাহেই শেষ হচ্ছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে অংশীজনের মতবিনিময়। সরকার নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যেই কমিশন তার সুপারিশ প্রকাশ করতে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের এক মাস পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ছয়টি কমিশন গঠনের কথা জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ৯০ দিনের মধ্যে এই কমিশনের সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর নির্বাচন ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনগুলোর প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। 

অংশীজনের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ গতকাল সন্ধ্যায় সমকালকে বলেন, অংশীজনের সঙ্গে আলোচনায় বিভিন্ন প্রস্তাব পাওয়া গেছে। তবে কমিশনের কাজের পরিধি, শর্তাবলি এবং মেয়াদ সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধানের কোন কোন স্থানে সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন করতে হবে, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। তবে কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধন হবে বা সংশোধনী বৈধতা পাবে, সেটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকার নির্ধারণ করবে। 

এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সরকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কমিশনের সুপারিশ প্রকাশ করা হবে। এরপর কোন প্রক্রিয়ায় সংশোধনের বৈধতা দেওয়া হবে সে বিষয়ে সরকার যদি কমিশনের মতামত চায়, তখন এসব বিষয়ে নিয়ে আমরা ভাবব। 

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই সংবিধান সংস্কার নিয়ে নানা আলোচনা হয়। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া ছাত্রনেতৃত্ব চেয়েছিল, আওয়ামী লীগ বাদে সব রাজনৈতিক শক্তি, নাগরিক সমাজ এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে নতুন সংবিধানের খসড়া করা হবে। তারপর তা গণভোটে অনুমোদন করানো হবে। 

তবে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান পুনর্লিখনে রাজি হয়নি। কীভাবে সংস্কার করা হবে– এ প্রশ্নে ছাত্রনেতৃত্বের ভাষ্য, বাহাত্তরে রাষ্ট্রপতির আদেশে যেভাবে অস্থায়ী সংবিধান দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে সংস্কার করা যেতে পারে। পরবর্তী সংসদ তা অনুমোদন করবে। দ্বিতীয় ভাবনায়, বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগের কাছে রেফারেন্স চাওয়া হবে। সর্বোচ্চ আদালত গণভোটের পক্ষে মতামত দিলে, সংবিধানের সংস্কার সেখানে অনুমোদিত হতে পারে। 

সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, অংশীজনের মধ্যে যারা গণভোটের প্রস্তাব করছেন, তাদের যুক্তি হলো– নির্বাচন হওয়ার পরপরই রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা যে কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, এবারও সে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন সংসদে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো আসন পাওয়া অন্য কোনো দলের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়া নির্বাচনে জয়ী দলের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।

সংস্কার কমিশনের কাছে অংশীজনের পক্ষে আরও যেসব প্রস্তাব পাওয়া গেছে, এর মধ্যে রয়েছে– রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে ভারসাম্য আনা; এই প্রস্তাবে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির হাতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রাখা; প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ন্যায়পালসহ সব ধরনের সাংবিধানিক পদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা নিশ্চিত করা; জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া।

সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা এ মাসের মধ্যে শেষ হবে। যদি কোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, তাহলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সুপারিশের খসড়া প্রকাশ করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে দেওয়া হবে। সরকার সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কী প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করবে এবং তা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হবে, সেটি তারা নির্ধারণ করবে।

তত্ত্বাবধায়ক ও গণভোট সংবিধানে কীভাবে ফিরবে– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অংশীজনের কাছ থেকে নানা মতামত পাওয়া গেছে। আদালতের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, আদালতের রায় প্রকাশের পর আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি যেভাবে ব্যাখ্যা করবেন, সেভাবে হবে। কমিশন হিসেবে এখানে ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই। কমিশনের কাজের পরিধির মধ্যে এটা পড়ে না।

এদিকে গতকাল রোববার সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে মতবিনিময়ে অংশ নেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ, ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী, অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দীন খান। সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে তারা সংবিধান সংস্কারে বেশ কিছু সুপারিশ ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।

অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে সভায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ড. শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, ফিরোজ আহমেদ ও মুসতাইন বিল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ৩ নভেম্বর সংবিধান সংস্কারের সাতটি উদ্দেশ্যের কথা তুলে ধরেন কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ। এগুলো হচ্ছে– দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো; রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা; ভবিষ্যতে যে কোনো ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার উত্থান রোধ; রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ– নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথককরণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা; রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button