Hot

সউদী শ্রমবাজারে বিপর্যয়ের শঙ্কা

প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের একগুঁয়েমিতে লক্ষাধিক কর্মী বিপাকে বহির্গমন ছাড়পত্র মিলছে না, ১ আগস্ট থেকে নতুন শর্তের বেড়াজাল

বাংলাদেশের প্রায় কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। বিশ্বের বহুদেশেই বাংলাদেশের শ্রম বাজার তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় শ্রম বাজার মধ্যপ্রাজ্যের দেশ সউদী আরব। অথচ সেই সউদী আরবের শ্রমবাজার অনিশ্চয়তার দিকে গড়াচ্ছে। দেশের আঠারো শ’ বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে লক্ষাধিক সউদীর একক ভিসা ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একগুয়েমি সিদ্ধান্তের দরুণ গত ১৩ জুন থেকে দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়া সউদীর একক ভিসার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ রয়েছে। ফলে সউদী গমনেচ্ছু কর্মীরা দেশটিতে যেতে না পেরে চরম হতাশায় ভুগছেন। জনশক্তি রফতানির সর্বোচ্চ দেশ সউদীগামী কর্মীদের বহির্গন ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশটিতে প্রায় ত্রিশ লাখ বাংলাদেশি কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন। প্রবাসী মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশটিতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি কর্মী সঠিকভাবে কাজ ও বেতন পাচ্ছে না। এজন্য কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্রে দূতাবাসের সত্যায়নের বিষয়টি নিশ্চিতকরণে জোর দেয়া হচ্ছে।

এবার ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে চলতি মাসের শুরু থেকেই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ফলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। চলতি জুন মাসের প্রথম ২১ দিনে প্রবাসীরা ১৯১ কোটি ৪৩ লাখ ৭০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। সউদীর শ্রমবাজার বন্ধ থাকলে রেমিট্যান্স খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। রেমিট্যান্স আয়ের ভাটার টান শুরু হলে জাতীয় অর্থনীতিতে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। একাধিদক জনশক্তি রফতানিকারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

দেশটির একক ভিসার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ থাকায় অনেক সউদী গমনেচ্ছু কর্মীর ভিসা ও মেডিকেলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। শত শত সউদীগামী কর্মীর বিমানের টিকিট বুকিং দিয়ে টিকিট বাতিল করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সউদীগামী কর্মীরা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে বায়রার শীর্ষ পর্যায়ের দু’টি প্রতিনিধি দল অতি সম্প্রতি দু’দফা প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ও প্রবাসী সচিব মো.রুহুল আমিনের সাথে দ্বি-পাক্ষিক বৈঠক করা হলে নতুন শর্তসাপেক্ষে সউদীর বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম চালুর আশ্বাস দেয়া হয়। এ ব্যাপারে প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে জরুরিভিত্তিতে বিএমইটিতে চিঠি দেয়ার কথা জানানো হয়। প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর সাথে গত সপ্তাহে বায়রা নেতৃবৃন্দের সর্বশেষ বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন শর্তসাপেক্ষে আগামী ১ জুলাই থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র চালুর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। নতুন শর্তের মধ্যে রয়েছে সউদীতে গিয়ে যাতে কর্মীরা কাজের নিশ্চয়তা এবং বেতন ভাতা ঠিকমতো পায় সেজন্য সউদী নিয়োগকর্তার সাথে বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির চুক্তি কপি ১ জুলাই থেকে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। একক ভিসার কর্মীরা সউদীতে গিয়ে কাজ ও বেতন ভাতা না পেলে সকল দায়-দায়িত্ব রিক্রুটিং এজেন্সিকে লিখিত অঙ্গিকারনামা দাখিল করতে হবে। এ ব্যাপারে বিএমইটিতে আজো চিঠি পৌঁছেনি। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এতথ্য নিশ্চিত করেছে।

প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর সাথে বায়রা নেতৃবৃন্দে বৈঠকে নতুন শর্তসাপেক্ষে সউদীর একক ভিসার বহির্গমন চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে ওই দিন বিকেলেই এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে জরুরিভিত্তিতে চিঠি ইস্যুর প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও অজ্ঞাতকারণে চিঠি ইস্যু হয়নি।
উল্লেখ্য, গত ১৩ জুন থেকে বিনা নোটিশে দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়া সউদী আরবের একক ভিসার কর্মীদের বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রুহুল আমিনের একক সিন্ধান্তে প্রবাসী প্রতিমন্ত্রী মো. শফিকুর রহমান চৌধুরীকে অবহিত না করেই বিএমইটিতে সউদী গমনেচ্ছুদের বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম দূতাবাসের সত্যায়নের অযুহাতে বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে প্রায় ১৮শ’ রিক্রুটিং এজেন্সির অধীনে সউদী গমনেচ্ছু হাজার হাজার কর্মী বহির্গমন ছাড়পত্র না পেয়ে চরম হতাশার সম্মুখীন হয়। বায়রার সূত্র জানায়, যুগ যুগ ধরে ২৪টি সউদীর ভিসার নীচে একক ভিসা দূতাবাসের কোনো প্রকার সত্যায়ন ছাড়াই বিএমইটি থেকে বহির্গমন ছাড়পত্র দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় গত ১ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিএমইটি থেকে ৫৩ হাজার ২৫৪ জন সউদীগামী কর্মী বহির্গমন ছাড়পত্র লাভ করে দেশটিতে যায়।

গত ১ জুন থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত পূর্বের ন্যায় ২৫ হাজার ১২৪ জন কর্মী সউদীর বহির্গমন ছাড়পত্র লাভ করে। কিন্ত ১৩ জুন দুপুর পর্যন্ত সউদীগামীদের বহির্গমন ছাড়পত্রের ফাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর হবার পরেই হঠাৎ করে প্রবাসী সচিবের তুঘলকি সিদ্ধান্তে সউদী গমনেচ্ছু হাজার হাজার একক ভিসার কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র আটকে দেয়া হয়। এতে সউদীগামী কর্মীরা চরম বিপাকে পড়েন। ভুক্তভোগি কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দায়িত্বহীন ব্যক্তিদের একগুয়েমির সিদ্ধান্তের দরুণ সউদীর শ্রমবাজার নিয়ে নানা সঙ্কটের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে বহু ট্রাভেল এজেন্সি সউদীগামী কর্মীদের লাখ লাখ টাকার অফেরৎযোগ্য টিকিট কিনে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। সউদীগামী কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র বন্ধ করে দেয়ায় ক্রয়কৃত টিকিট বাতিল হলেও টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। এছাড়া ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের একক ভিসায় দূতাবাসের সত্যায়ন না থাকায় বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ রয়েছে। এতে পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। এসব দেশের কর্মীদের ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

একজন জনশক্তি রফতানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সউদীর একক ভিসার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু দূতাবাসের সত্যায়নের অযুহাতে বন্ধ থাকায় ১৮শ’ রিক্রুটিং এজেন্সির লক্ষাধিক কর্মীর সউদী যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এতে সউদীগামী বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট খালি যাচ্ছে। তিনি বলেন, জনশক্তি রফতানির সর্বোচ্চ দেশ সউদীর শ্রমবাজারকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য দফায় দফায় দূতাবাসের অহেতুক সত্যায়নের দোহাই দেয়া হচ্ছে কি না তা’খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি সউদীর শ্রমবাজার দ্রুত চালুর লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামান করেন। বায়রার সাবেক ইসির সদস্য মোহাম্মদ আলী সউদীর একক ভিসার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু বন্ধ থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সউদী আরবের শ্রমবাজার নস্যাৎ করতে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কী না তা’খতিয়ে দেখতে হবে। দেশটিতে প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠিয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। তিনি বলেন, ভ্রাতৃ-প্রতীম সউদী আরবের সাথে বাংলাদেশে চমৎকার সর্ম্পক বিরাজ করছে। নতুন নতুন শর্ত আরোপ করে সউদীর বৃহৎ শ্রমবাজারে বাধার সৃষ্টি করা হলে রেমিট্যান্স খাতে আঘাত আসবে। তিনি জাতীয় স্বার্থে অবিলম্বে সউদীর একক ভিসার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু কার্যক্রম চালুর জোর দাবি জানান।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button