Bangladesh

সচিবালয় কার্যক্রম স্বাভাবিক বৈষম্য নিরসনের ৯ দফা দাবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, আতঙ্কে অফিসে আসছেন না দলবাজ সচিবরা

প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কার্যালয়ে ঘোরাও এক ঘন্টার পরে সচিবের আশ্বাসে কর্মকর্তারা কাজ শুরু করে। এর পরে সচিবালয় সকল মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে দলবাজরা ভয় এবং আতস্কে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব,কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব,স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব,স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবসহ বেশ কয়েকজন সচিব গতকালও অফিসে আসেনি। তবে জননিরাপত্তা সচিব অফিসে না আসলেও সরকারি কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রশাসনে কর্মরত যেসব উচ্চপস্থ কর্মকর্তারা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি এবং বিদেশে পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তাদের পদ থেকে সরানো হচ্ছে। অন্তরর্বতী সরকার গঠন করার পর নিয়োগের আদেশ এবং চুক্তি বাতিল প্রক্রিয়া চালু করা হবে। বদলী ও চুক্তিবাতিল প্রক্রিয়া শুরু আগেই বেশকয়েকজন সচিব পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন আবার কয়েকজন বিদেশ পালিয়েছেন বলে জজনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন ভিন্নমতের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন কর্মকর্তাও আছেন, যিনি গত ১৫ বছরেও একটি পদোন্নতিও পাননি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা সামনে আসতে শুরু করেছেন। বাংলাদেশ সচিবালয়ে বৈষম্যবিরোধী কর্মচারীরা সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার হচ্ছে। সচিবালয়ে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাগণের পদনাম পরিবর্তন, পেশাগত ও বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, বেতন কমিশন গঠনসহ দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশা নিরসনের জন্য আবেদন জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সচিব ইনকিলাবকে বলেন, সচিবালয়ের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়েছে। তার পরও কিছু কিছু সচিব অফিস করছে না। সে বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিবকে জানানো হয়েছে। তিনি বিষয়টি দেখবেন এবাং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাউদ্দিন চৌধুরীরর নিকট এসব দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি দেন বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, সরকারি চাকরিতে নিজেদের বিকশিত করার জন্য দীর্ঘদিন যাবত বিভিন্ন দাবি-দাওয়া যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর উপস্থাপন করা হলেও আজও কোন দাবি বাস্তবায়ন করা হয়নি। উচ্চতর পদসৃষ্টি, পদ সংরক্ষণ, পদোন্নতির ক্ষেত্রে অহেতুক জটিলতা সৃষ্টি, টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সংকুচিতকরণ, ৫০ শতাংশ পেনশন প্রদান, বাস্তবতার আলোকে পদনাম পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে কর্মচারীদের মাঝে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় পে-কমিশন, ২০১৫ ঘোষিত হবার পর আজ অবধি বেতন কমিশন গঠন করা হয়নি। বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ সকল দ্রব্যের মূল্য ক্রমাগতভাবে আকাশচুম্বী ও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মচারিদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গিয়েছে। নিম্নবেতনভূক কর্মচারীরা পরিবার-পরিজনসহ জীবিকা নির্বাহে আর্থিক সংকটে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এছাড়া বিগত ১৫-১৬ বছর যাবত কর্মচারিদের পেশাগত দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন না হওয়ায় কর্মচারিরা প্রশাসনিক, পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছে বলে নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করে অবিলম্বে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য নয় দফা দাবি সিনিয়র সচিবের নিকট দাখিল করেন।
দাবি গুলো হচ্ছে,সচিবালয়ে কর্মরত নন-ক্যাডারের ৩৭০টি পদসহ প্রতিটি পদের এক তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষণ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাগণের পদবি উপ-সহকারী সচিব নামকরণ, গ্রেড ১১-১৬ এর কর্মচারীদের চারটি পদকে অতিরিক্ত উপ সহকারী সচিব, গ্রেড ১৭-২০ গ্রেডের চারটি পদকে সচিবালয় সহকারী হিসেবে নামকরণ, নবম জাতীয় পে-কমিশন গঠন, পূর্বের ন্যায় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ন্যায় সচিবালয়ে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে অবিলম্বে ২০ শতাংশ টিপটপ ভাতা প্রদান, শতভাগ পেনশন অবিলম্বে পুনর্বহাল,পেনশন গ্র্যাচুইটির হার ১:৫০০ টাকা অবিলম্বে নির্ধারণ এবং সচিবালয়ে সকল শ্রেণির ব্লকড পদ বিলুপ্ত করে সমপদনাম বা মর্যাদা ও বেতন গ্রেডের পদে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানানো হয়েছে।এসব দাবি গুলো বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সচিবালয়ের প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে একজন করে সমন্বয়কের মাধ্যমে পদনাম পরিবর্তন ও নবম পে-কমিশন অবিলম্বে গঠন করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে কর্মচারীরা এ প্রতিবেদককে জানান।আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন ভিন্নমতের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন কর্মকর্তাও আছেন, যিনি গত দেড় দশকে একটি পদোন্নতিও পাননি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা সামনে আসতে শুরু করেছেন।
চুক্তিতে নিয়োগ নিয়ে এমনিতেই কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তারা বলছেন, একজন কর্মকর্তা চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে গেলে সেই পদ খালি হয়। ওই পদে নতুন একজন কর্মকর্তার পদোন্নতি বা পদায়ন হয়। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে বঞ্চিত হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনসহ জনপ্রশাসনে বর্তমানে ১৮ জন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সচিবালয়ে অবস্থিত একটি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকের স্বপ্ন থাকে এক দিন সচিব হবেন, বড় মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পাবেন। কিন্তু বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অনেকে সে স্বপ্ন পূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি কাম্য নয়। অপর কর্মকর্তা বলেন, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ মানে একজন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা। একটি পদ খালি হওয়ার পর আরেকজন কর্মকর্তা সেই পদে বসবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের কারণে ওই পদে আগের কর্মকর্তাই থেকে যাচ্ছেন। ফলে নতুন করে যার দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তিনি কিন্তু বঞ্চিত হলেন। এক সময় দেখা গেল তার নিজেরই চাকরির মেয়াদ শেষ। ফলে মনে কষ্ট নিয়ে তাকে সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে বৈঠক করেছেন ২০ ব্যাচের বঞ্চিত কর্মকর্তারা। এরা হলেন, শ্রীনিবাস দেবনাথ, মো. খয়বর রহমান, মো.শাহাতদ হোসেন, খলিল আহমেদ, জাকির হোসেন, শামিমা সুলতানা, মো. মোস্তফা জামান, মোহাম্মদ আবুল কাশেম, নাজমুল হুদা শামিম,মো. নুরুজ্জামানসহ অনেক কর্মকর্তা। এর আগে গত মঙ্গলবার ও সচিবালয়ে বৈঠক করেছেন বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অবসরে যাওয়া বিএনপি-জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা এবং প্রশাসনে বর্তমানে কর্মরত পদোন্নতিবঞ্চিত অন্তত ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১১টায় শুরু হওয়া এ বৈঠক চলে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। সেখানে সভাপতিত্ব করেন বিসিএস ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. নেয়ামত উল্লাহ ভূঁইয়া। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ১৩তম ব্যাচের পদোন্নতিবঞ্চিত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মাহবুবুর রহমান। বৈঠকে পদোন্নতি বঞ্চিত করার হিসাব এবার কড়ায়-গন্ডায় আদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন প্রশাসনের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এখন থেকে তাঁদের পরামর্শ ছাড়া কোনো আদেশ (প্রজ্ঞাপন) জারি করা চলবে না।
সভায় বক্তব্য দেন অবসরে যাওয়া বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. আব্দুস সবুর, ৮৪ ব্যাচের ওয়াহিদ জামান, ৮৫ ব্যাচের জাকির হোসেন কামাল, ১১ ব্যাচের এহসানুল হক, ১৩ ব্যাচের মাহফুজুর রহমান, ২০ ব্যাচের মির্জা আলী আশরাফ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রটোকল অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম, ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এপিএস সুরুতুজ্জামান, ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম, ২৪ ব্যাচের নুর জাহান খানম, বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের মহাসচিব তোয়াহা মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম প্রমুখ। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, তিনি বিএনপিপন্থী বলে গত ১৬ বছরে কোনো পদোন্নতি পাননি। অথচ তাঁর ব্যাচমেট কর্মকর্তাদের অন্তত ২০ জন বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব হয়েছেন এক বছর আগেই। তিনি বলেন, কাজ করতে পারি বলে ওএসডি থাকতে হয়নি। আমার সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপসচিব আবু নাসার উদ্দিন ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা; যিনি আমার ১৪ বছর পর চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। শুধু তিনিই নন, প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা শুধু সরকার-সমর্থক না হওয়ায় পদোন্নতি পাননি। বুকে কষ্ট নিয়ে সরাসরি জুনিয়রের অধীনে কাজ করছেন বছরের পর বছর।
১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা এহসানুল হক বলেন, আজ পাওয়া না পাওয়ার হিসাবের দিন নয়, আজ হচ্ছে মিলনমেলা। যে সাথিদের বছরের পর বছর দেখিনি, যারা বুকভরা বেদনা দিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। যাদের কথা বলার কিংবা বসার কোনো জায়গা সচিবালয়ে ছিল না, তাদের মুখগুলো দেখতে এসেছি। আজ আমরা একটু হালকা হওয়ার জন্য মিলিত হয়েছি। পাওয়ার হিসাব পরে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button