Hot

সড়কের শৃঙ্খলা ঢিলেঢালা, মামলায় তোড়জোড়

যত্রতত্র পার্কিং, ফিটনেসহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চলাচলসহ ঢাকার সড়কে দীর্ঘদিন ধরে বিশৃঙ্খলার সাতকাহন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পুলিশ কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল সড়কেও। শৃঙ্খলা ফেরাতে আবার কাজ শুরু করেছে ট্রাফিক পুলিশ। পুরোপুরি ফেরেনি শৃঙ্খলা, তবে পুলিশ এখন গুরুত্ব দিচ্ছে মামলা। ‘পর্যাপ্ত’ মামলা না করায় গত ডিসেম্বরে অর্ধশতাধিক সার্জেন্টকে কারণ দর্শানো (শোকজ) নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর ফকিরাপুল, পল্টন ও গুলিস্তানে একাধিক ট্রাফিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশমতো মাঠে কাজ করছেন তারা। খারাপ আচরণ এবং কঠোর হওয়া থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ তাদের। তবে সম্প্রতি মামলা করার জন্য অলিখিত চাপ রয়েছে।

পুলিশ সদস্যরা বলছেন, রাস্তায় চলাচলকারী অনেকে ট্রাফিক আইন মানতে চান না। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করছেন। ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও ব্যস্ত সড়ক হেঁটে পার হন। ট্রাফিক আইন মানার পরামর্শ দেওয়া হলে কারও কারও সঙ্গে তর্ক হয়। আবার চলমান পরিস্থিতির কারণে পুলিশ কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে পারছে না।

গত শনিবার পান্থপথ মোড়ে প্রাইভেটকার পার্ক করায় মামলা করেন সার্জেন্ট। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে চালক কেরামত আলী বলেন, ‘আপনি উল্টো পথে এসে মামলা করছেন কেন? সাধারণ মানুষ দাঁড়ালেই অপরাধ!’ চালকের অভিযোগ, ‘আমাদের সঙ্গে অনেকে ভাড়ায় প্রাইভেটকার চালায়। অনেকের মাসিক চাঁদা নির্ধারণ আছে। তাদের গাড়ি কোথাও ধরে না, মামলাও হয় না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মতিঝিল বিভাগের এক সার্জেন্ট সমকালকে বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে গাড়িতে মামলা করার একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকত। কিছু দিন সেটা বন্ধ ছিল। এখন আগের মতো মৌখিকভাবে মামলা করার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন পাঁচ-সাতটি মামলা করার কথা বলা হয়েছে। নির্দিষ্টসংখ্যক মামলা না দিলে শোকজ করা হয়।’

সার্জেন্টদের দেওয়া শোকজে লেখা হয়– ‘বিধিমোতাবেক নির্দেশনা থাকলেও আপনি স্বল্পসংখ্যক মামলা করেছেন। এটা কর্তব্যে অবহেলা, শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য করার শামিল।’

পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা দুই শিফটে কাজ করেন। প্রথম শিফট সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বেলা আড়াইটা। দ্বিতীয় শিফট বেলা আড়াইটা থেকে রাত ১১টা। এ ছাড়া রাজধানীর বেশ কিছু পয়েন্টে রাত সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ২টা, আবার কোনো পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টা ট্রাফিক সদস্য থাকে। পুলিশ সদস্যরা হাতের সংকেতে রোদ, বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন করেন।

গত তিন রাত রাজধানীর বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ব্যস্ত কয়েকটি সিগন্যালে রাত ১০টার পর থেকে এলোমেলো গাড়ি চলতে থাকে। আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করায় ভজকট দশা তৈরি হয়। জাতীয় সংসদ ভবন সিগন্যাল, পান্থপথ, বিজয় সরণি, মিরপুর ১০ নম্বর, আগারগাঁওসহ কয়েকটি জায়গায় মধ্যরাতে এলোমেলোভাবে গাড়ি আটকে থাকতে দেখা যায়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন ঘরমুখো মানুষ।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ‘দেখা যায়, কোনো পয়েন্টে শত শত মানুষ ও গাড়ির চালক নিয়মিত ট্রাফিক সংকেত অমান্য করছেন। কিন্তু সেখানে মামলা করা হচ্ছে না। যদি এই ধরনের পয়েন্টে দায়িত্ব পালন করা সার্জেন্ট মাসে দু-তিনটি মামলা না করেন, তখন তাঁকে শোকজ দেওয়া হচ্ছে। এখন পুরো রাজধানীতে ৬০০ শিক্ষার্থী ট্রাফিক পুলিশের সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন।’

ট্রাফিক মতিঝিল বিভাগের ডিসি দেওয়ান জালাল সমকালকে বলেন, ‘সার্জেন্টদের কাজের মূল্যায়ন ও পুরস্কারের অন্যতম নির্ধারক হলো মামলা। এটা এ রকম নয়, দিনে নির্দিষ্ট সংখ্যক মামলা করতে বলা হয়েছে। মাসে যদি কেউ দু-তিনটি মামলা করে, সেটা হতে পারে না।’

ট্রাফিক পুলিশের তেজগাঁও ও মিরপুর বিভাগের ডিসি রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘তিন-চার দিন যখন ছুটি হয়, তার আগে ও পরে রাজধানীর কিছু পয়েন্টে মধ্যরাতে যানবাহনের চাপ থাকে। এতে কখনও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এটি কীভাবে এড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করছি। এ ছাড়া সকাল ও বিকেলে যখন সড়কে ব্যস্ততা থাকে, তখন ট্রাফিক সহায়তাকারী হিসেবে ছাত্ররা আমাদের সহযোগিতা করছে। জেব্রা ক্রসিংয়ে পারাপার, সঠিক স্থানে পার্কিংসহ পথচারীদের তারা সচেতন করছেন। এতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুই বিভাগে মামলা করার কোনো লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে না। বরং বলা হচ্ছে– কারও বিরুদ্ধে মামলা করার আগে যেন ভাবা হয় ওই লোকটি তার আপনজন।’

শান্তিনগর মোড়ের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দীর্ঘদিন এই এলাকায় ব্যবসা করি। প্রায়ই বেইলি রোডের মুখে বাসের পাল্লাপাল্লি দেখা যায়। এতে দুর্ঘটনাও ঘটে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ১০ আগস্ট থেকে স্বল্প পরিসরে রাজধানীর সড়কে কাজ শুরু করে ট্রাফিক পুলিশ। শুরুতে মাসখানেক অল্প সদস্যের উপস্থিতি দেখা যায়।  সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে মামলা কার্যক্রম শুরু হয়।  ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ২১ হাজার ৪৪৭টি মামলা এবং প্রায় ৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে ট্রাফিক বিভাগ। গেল ডিসেম্বরে মামলা হয়েছে অন্তত ৪৩ হাজার।  এর মধ্যে ১ হাজার ১১৩টি গাড়ি পার্কিং সংক্রান্ত। এছাড়া ১ হাজার ১৭০ গাড়ি রেকারিং করা হয়েছে।

এ সময়ে ৫৮ হাজার ১৯৬টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ ডাম্পিং করা হয়েছে ২ হাজার ৫২৯টি যানবাহন। ডিএমপির তথ্য বলছে, ১ থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ৭ হাজার ৪৭টি মামলা করেছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এ সময় ১৫৬টি গাড়ি ডাম্পিং এবং ২১৭টি গাড়ি রেকার করা হয়। বাকি মামলা হয়েছে অবৈধ পার্কিং, চালক ও গাড়ির লাইন্সেস না থাকা এবং ট্রাফিক আইন ভঙ্গসহ বিভিন্ন অভিযোগে।

২০২৩ সালে রাজধানীতে ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫২২টি। এর মধ্যে তেজগাঁও অঞ্চলে ৬৫ হাজার ৬৩৭টি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মিরপুর, মামলা ৪৯ হাজার ৯০২টি। তৃতীয় রমনা, মামলা ৪২ হাজার ৩৪০টি। সবচেয়ে কম ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনা ঘটেছে মতিঝিলে, মামলা ২৯ হাজার ৬২৬টি। এসব মামলা বাবদ ৭২ কোটি ৭ লাখ ২৩ হাজার ৯৬৩ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ট্রাফিক আইন অনুযায়ী, অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, অবৈধ পার্কিং, উল্টো পথে চালানো, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি, ভুয়া লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক সংকেত অমান্য, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যত্রতত্র ইউটার্ন নেওয়া, সিটবেল্ট না বাঁধা, হেলমেট ব্যবহার না করা, চলন্ত গাড়িতে চালকের ফোনে কথা বলা, সড়কে প্রকাশ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ বেশ কয়েকটি কারণে জরিমানা করে ট্রাফিক পুলিশ।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto