সপ্তাহজুড়ে আলোচনায় ‘মুরাদনগর’: কী হচ্ছে সেখানে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে এক নারীর সাথে নিপীড়নমূলক আচরণসহ ধর্ষণ এবং একই পরিবারের তিন সদস্যকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় মুরাদনগর রুপ নিয়েছে এক অপরাধরাজ্যে।
হঠাৎই টপ অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে কুমিল্লার ‘মুরাদনগর’। সপ্তাহজুড়ে কী হচ্ছে সেখানে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে এক নারীর সাথে নিপীড়নমূলক আচরণসহ ধর্ষণকাণ্ড এবং একই পরিবারের তিন সদস্যকে পিটিয়ে খুনের ঘটনায় মুরাদনগর রুপ নিয়েছে এক অপরাধরাজ্যে।
ওই নারী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে মামলাও করেছেন। প্রথমে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে জানালেও পরে মামলা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলীসহ গ্রেফতার হওয়া পাঁচজন কোন দলের এ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জল ঘোলা কম হয়নি। সেখানে আসলেই কী ঘটেছে বা কারা ঘটিয়েছে এর তদন্তে তৎপর রয়েছে পুলিশ। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগী নারীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসাথে সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন থেকে ভুক্তভোগীর ভিডিও ও ছবি সরাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। এ ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হবে বলে জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। এ ঘটনা নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
জানা যায়, মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর পাচকিত্তা গ্রামের ফজর আলীর ধর্ষণের শিকার হন বলে মামলায় অভিযোগ করেন এক নারী। ওই ঘটনার সময় সুমন নামের একজনের নেতৃত্বে ওই নারীকে বিবস্ত্রের পর মারধর ও ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়। এদিকে পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ফজর আলীসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। অভিযুক্ত ফজর আলীকে (৩৮) গ্রেফতার করা হয় ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে। এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় গ্রেফতার চারজন হলেন প্রতিবেশী অনিক, সুমন, রমজান ও বাবু। ভুক্তভোগী নারী জানান, তিনি বিবাহিত। দু’ সন্তানের জননী। ফজর আলী নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে তার মা ৫০ হাজার টাকা ধার নেন। টাকা নিয়ে তার সাথে কথা হতো। এটি মেনে নিতে পারেননি ফজর আলীর ছোট ভাই শাহ পরান। এ নিয়ে দু’ ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। গত ২৬ জুন রাত সাড়ে ১১টার সময় ওই নারীর বাবার বাড়িতে যান ফজর আলী। ১৫ দিন ধরে তিনি বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ফজর আলী যে সময় ভুক্তভোগীর বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন, ওই সময়ে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বাড়ির অন্য সবাই বাইরে অবস্থান করছিলেন। সে সুযোগে ঘরে প্রবেশ করেন ফজর আলী। ঘরে প্রবেশের তিন মিনিটের মধ্যে চারজন যুবক এসে ওই নারী ও ফজর আলীকে বেদম মারধর করেন। এ সময় বিবস্ত্রের পর ভিডিওচিত্র ধারণ করা হয়। স্থানীয়দের ধারণা, ফজর আলীর পেছনে তরুণদের লাগিয়ে দেন তার ভাই শাহ পরান। ২৭ জুন ফজর আলীকে আসামি করে ধর্ষণের মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। এদিকে বিবস্ত্র মারধরের ভিডিওচিত্র ২৮ জুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী তীব্র সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুর রবের বক্তব্যে জানা যায়, ‘ফজর আলী আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে চলাফেরা করতেন। এখন বিএনপির পরিচয় দেন। তার কোনো পদ-পদবি নেই। মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান জানান, গ্রেফতার পাঁচজনের মধ্যে সুমন রামচন্দ্রপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। সুমনের নেতৃত্বে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং ভিডিও ধারণ করা হয়। গ্রেফতার হওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খাঁন জানান, ভুক্তভোগী নারীর মামলায় মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মুরাদনগরে ‘ধর্ষণ’ : চার আসামির ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর
ওই নারীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ছাড়ানোর ঘটনায় পর্নোগ্রাফি আইনের মামলায় গ্রেফতার চারজনকে তিন দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লার আমলি আদালত-১১-এর বিচারক বিচারক মমিনুল হক তাদের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে আদালত পুলিশের ওসি সাদেকুর রহমান জানিয়েছেন।
এর আগে মঙ্গলবার ওই চারজনের সাতদিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুরাদনগর থানার এসআই রুহুল আমিন।
আসামিরা হলেন মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর পাঁচকিত্তা গ্রামের সুমন, রমজান, মো: আরিফ ও মো: অনিক।
মুরাদনগরের ধর্ষণের ঘটনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবে সরকার :
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আলোচিত ধর্ষণের ঘটনাটি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবে। তিনি বলেন, ‘মুরাদনগরে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এ ঘটনায় দেশের যে কোনো নাগরিকের মতো আমরা সবাই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়েছে।’
এদিকে কুমিল্লার মুরাদনগরে পাশবিক নির্যাতনের শিকার সেই নারীকে সরকার সার্বিক সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
উপদেষ্টা বুধবার মুরাদনগরে এসে এ আশ্বাস দেন। অবশ্য ভুক্তভোগী নারী ঘটনাস্থল বাবার বাড়িতে না থাকায় তার সাথে দেখা হয়নি উপদেষ্টার। পরে তিনি মুঠোফোনে ওই নারীর সাথে কথা বলে এ আশ্বাস দেন।
বুধবার বিকেলে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ মুরাদনগরে যান। এ সময় ভুক্তভোগী বাড়িতে না থাকায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুরাদনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমীনের মুঠোফোনে তিনি নির্যাতনের শিকার ওই নারীর সাথে কথা বলেন। এ সময় তিনি ঘটনার সাথে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে বসে উপদেষ্টা মুঠোফোনে ওই নারীর সাথে কথা বলেন।
‘কুইক রেসপন্স টিম’ গঠনের ঘোষণা
বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলা পরিষদের কবি নজরুল মিলনায়তনে উপজেলার কর্মকর্তা ও সুধীজনদের সাথে মতবিনিময় করেন উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ। এ সময় নারী নির্যাতন ও হয়রানি রোধ এবং নারী ও শিশুদের দ্রুততম সময়ে উদ্ধার, আইনি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ইউএনওকে প্রধান করে মুরাদনগর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কুইক রেসপন্স টিম’ গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। তিনি বলেন, মুরাদনগর থেকেই ‘কুইক রেসপন্স টিমের’ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন : এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপি। কুমিল্লা নগরের একটি কমিউনিটি সেন্টারে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ আত্মগোপনে চলে যায়। স্থানীয় ওসি ও একজন উপদেষ্টার বাবার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা আবার মাঠে সক্রিয় হয়েছে।
এদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি হিন্দুধর্মাবলম্বী এক নারীকে শ্লীলতাহানি ও নির্যাতন এক নির্মম কলঙ্কজনক ঘৃণ্য ঘটনা। এই বর্বরোচিত ঘটনা দেশের মানুষকে ব্যথিত ও মর্মাহত করেছে।’
কঠোর শাস্তি চান জামায়াত আমির : মুরাদনগরে ঘরের দরজা ভেঙে প্রবাসীর স্ত্রী ধর্ষণের তোলপাড় করার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান। এ ঘটনাকে লজ্জাজনক আখ্যায়িত করে এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন তিনি।
মুরাদনগরে বাড়ি ঘেরাও করে মা-ছেলেসহ তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা
অপরদিকে, কুমিল্লার মুরাদনগরে মাদক কারবার ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলে একটি বাড়ি ঘেরাও করে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী। তাদের মধ্যে দু’জন নারী একজন পুরুষ। এ ঘটনায় একজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার করইবাড়ী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন করইবাড়ী গ্রামের রুবি আক্তার (৪৫), তার ছেলে রাসেল (২৫) এবং আরেক নারী জোনাকী (৩২)। গুরুতর আহত অবস্থায় রুবির অপর স্বজন রোমা আক্তারকে (৩৫) কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।
বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নিহত ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় মাদক ব্যবসা, ডাকাতি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মুরাদনগর, নবীনগর ও বাঙ্গরা বাজার থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। তারা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রুবি আক্তার ও তার পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মাদক কেনাবেচা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী হামলা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিলেন। তাদের কারণে এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বহুবার প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে। পরে উত্তেজিত জনতা সংঘবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা চালায় এবং লাঠিসোঁটা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান এবং একজন গুরুতর আহত হন।
খবর পেয়ে বাঙ্গরা বাজার থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং নিহতদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। আহত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ওসি মাহফুজুর রহমান আরো জানান, পরিস্থিতি বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনার সাথে কারা জড়িত ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং এ ব্যাপারে আইনিব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা দায়ের হয়নি, তবে তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এ ঘটনার পর থেকে করইবাড়ী গ্রামে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত রাখতে টহল জোরদার করেছে এবং এলাকাবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।