সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে চলে যায়, আমাদের দুঃখ শেষ হয় না
‘একেক বার ঝড় আসে, বাড়িঘর সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে সেই ঝড় চলেও যায়—আমাদের দুঃখ শেষ হয় না। এই ঝড়ঝাপটার সঙ্গেই আমাদের ঘর-সংসার, আমাদের জীবনযাপন’। ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলবাসীর বুকভরা হতাশা আর কষ্টের উক্তি এটি। ঐ উক্তির মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাদের কষ্ট, হতাশা আর জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপে ব্যাপক ক্ষতি হয়, যার দগদগে ক্ষতচিহ্ন কবে যাবে জানে না উপকূলবাসী।
গত ২৬ মে রাতে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডব ও জলোচ্ছ্বাসে কয়রা উপজেলার দশালিয়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদের প্রায় আধা কিলোমিটার জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ শুরু হয়। তাৎক্ষণিক স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে এলাকাবাসী বাঁধের ওপর বস্তা দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুপুরের জোয়ারে শেষরক্ষা হয়নি তাদের। কপোতাক্ষ নদের দুটি স্থানের প্রায় ৭০ মিটার বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়। এরপর গত বুধবার ভোর থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সহায়তায় পাঁচ শতাধিক স্থানীয় জনগণ ফের বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। ঐ দিন দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চেষ্টা করে দুটি পয়েন্টে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয় তারা। সেখানে অর্ধশতাধিক পরিবার এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। তারা জোয়ারের সময় খাটের ওপর অথবা বাঁধের ওপর বসে থাকছে। অনেকের ঘর নষ্ট হয়ে গেছে।
দশহালিয়া গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য শাহাদাত হোসেন, স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুল, আরাফাতসহ কয়েকজন বলেন, কপোতাক্ষ নদের ঐ স্থান বারবার ভাঙছে। দুই বছর আগে পাউবো বাঁধ সংস্কার করলেও ফের ভেঙেছে।
গত রবিবার রাতের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পাইকগাছা উপজেলায়ও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে দেলুটি ইউনিয়নের মাঙ্গা নদীর ২০, ২১ ও ২২ নম্বর পোল্ডারের পাউবোর বেড়িবাঁধের বিভিন্ন পয়েন্ট ভেঙে গোপি পাগলা, হাটবাড়িয়া, ফুলবাড়িয়া, সৈয়দখালী, সেনের বেড়, খেজুরতলা, বিগরদানা, দুর্গাপুর, কালীনগর, দারুণমল্লিক, নলডাঙ্গাসহ অন্তত ১৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এসব এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচা ঘরবাড়ি ধসে গেছে। অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে পাউবোর বেড়িবাঁধসহ আশপাশের রাস্তার ধারে পলিথিনের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। এতে জীবন কাটছে অতি কষ্টে।
তেলিখালী গ্রামের দেবাশীষ গাইন ও নজরুল মোড়ল জানান, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তাদের এলাকার ৯০ শতাংশ মাটির ঘর ধসে গেছে। অধিকাংশ পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে বাঁধের ওপর জবুথবুভাবে বসবাস করছে।
ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তের দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই দাকোপ উপজেলার মানুষ। ছোট-বড়ো সব দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সঙ্গী তারা। বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবন উপকূলে ঘূর্ণিঝড় এলে প্রথম আঘাত হানে তাদের ওপর। ঘূর্ণিঝড় রেমালও এর ব্যতিক্রম করেনি।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় জলোচ্ছ্বাসে দাকোপ উপজেলার দক্ষিণ কামিনীবাসিয়া গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণপানি লোকালয়ে প্রবেশ করে। পরদিন সকালে ভাঙা বাঁধ মেরামতের জন্য কাজ শুরু হয়। বাঁধের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হতেই আবার জোয়ার চলে আসে। জোয়ারের চাপে একপর্যায়ে পানিতে ভেসে যায় বিকল্প বাঁধ। এতে তিলডাঙ্গা ও পানখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে যায়।
খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিভাগীয় উপসহকারী প্রকৌশলী মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা জনগনের সঙ্গে থেকে সার্বক্ষণিক বাঁধের তদারক করছি। বাঁধ নির্মাণের সব সরঞ্জাম আমরা সরবরাহ করছি। শ্রমিকের মজুরিও পরিশোধ করা হবে।
এদিকে, ঝড়ের পর গত শুক্রবার দুপুরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ভেঙে যাওয়া বেড়িবাঁধের স্থান পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে ১৩৯টি পোল্ডার রয়েছে। যে পোল্ডারগুলো ষাটের দশকে তৈরি হওয়ার কারণে বর্তমানে খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যে ১০টি পোল্ডারকে মজবুত করা হয়েছে। এছাড়া অল্প সময়ের মধ্যে আরো ২০টি পোল্ডারের কাজ করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাকি পোল্ডারগুলোর বাঁধ শক্তিশালী করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করা হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ সাহা, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সবিবুর রহমান, খুলনা পাউবো-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম, পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহেরা নাজনীন, দেলুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিপন কুমার মন্ডল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুজয় কর্মকার প্রমুখ।