Hot

সবজির বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য, ঠকছেন কৃষক-ভোক্তা

মাঠ থেকে খুচরা পর্যায়ে মূল্যের ব্যবধান কয়েক গুণ * রাজধানীর তিন পয়েন্টে দিতে হচ্ছে চাঁদা * পাইকারি বাজারে চলছে কমিশন বাণিজ্য

সব ধরনের সবজিতে ভরপুর রাজধানীর খুচরা বাজার। তবুও দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে। কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচবার হাতবদল হচ্ছে। এতেই দুই থেকে চার গুণ দাম বেড়ে যাচ্ছে। তবে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে আরও বেশি। ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য, আড়ত এবং সড়কে চাঁদাবাজি দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়ছে।

এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণেই মূলত মধ্যস্বত্বভোগী লাভবান হলেও মাঠে কৃষক ও বাজারে ভোক্তারা ঠকছেন বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা। তাদের মতে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, দালাল-ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য এবং পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধের কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সবজির দামবিষয়ক প্রতিবেদনেও এমন তথ্য জানানো হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সবজির দাম বৃদ্ধির পেছনে পরিবহণ চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। তবে বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা গেলেও সংশ্লিষ্টরা প্রায় নির্বিকার।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পণ্য উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। এর মধ্যে আছে-স্থানীয় ব্যবসায়ী, মজুতদার, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকারী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপেই সবজির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে।

এর সঙ্গে আছে নামে-বেনামে চাঁদাবাজি। মহাসড়কে, টার্মিনালে, ফেরিঘাটে, নগরীর প্রবেশমুখে চাঁদা আদায় হচ্ছে। পাশাপাশি পাইকারি আড়তে সরাসরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। কমিশন বাণিজ্যে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে। এসব কিছু যোগ করে সবজির দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এর সঙ্গে লাভ যোগ করে খুচরা বিক্রেতা ভোক্তার হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যশোরে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেখানে আড়তে এই পণ্য বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি করলা বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা, আড়তে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৪ টাকা।

আর রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ ও খুচরা পর্যায়ে ৮০-৯০, দিন ভেদে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। একই ভাবে প্রতি পিস বড় আকারের লাউ কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাক। আড়তে ৪০ টাকা। আর রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ ও খুচরা পর্যায়ে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ময়মনসিংহে কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি বেগুন ২৫ টাকায় বিক্রি হলেও রাজধানীর খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। যা কৃষকের দাম থেকে তিন গুণের বেশি। একইভাবে ২০-৩০ টাকা কেজির শসা ঢাকায় বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকায়।

যশোরের সবজি ব্যবসায়ী মো. আতিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে ৩ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৩ হাজার টাকা। এখন ১৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ টনের ট্রাক ভাড়া ২১ হাজার টাকা। আগে ১৭-১৮ হাজার টাকা ছিল। এছাড়া যশোর থেকে একটি ট্রাক ঢাকায় আসতে পদ্মা সেতুতে টোল দিতে হয়। এছাড়া পথে যাত্রাবাড়ীতে শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে টোকেন দিয়ে ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়।

সবজির ট্রাক যদি কাওরান বাজারে আসে সেখানে গোপনে ১০০-২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। আর ট্রাক যদি শ্যামবাজারে যায়, সেক্ষেত্রে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া মোড় থেকে একটু সামনে টোকেন দিয়ে ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। পাইকারি বাজারে ব্যাপারীরা কমিশন বাণিজ্যের খপ্পরে পড়েন। ট্রাক থেকে সবজি নামাতে বস্তা প্রতি ১০০ টাকা কমিশন দিয়ে বিক্রি করতে হয়। সব মিলে সবজির দাম তিনগুণ বেড়ে যায়।

সম্প্রতি জাতীয় সবজি মেলা উদ্বোধনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, সবজির বিপণনে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবহণ চাঁদাবাজি হচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে।

কৃষককে লাভবান করতে ইতোমধ্যে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। আর এ ধরনের বাজার প্রত্যেকটি জেলায় করা হবে। যাতে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারেন। এতে করে কৃষকের সঙ্গে ভোক্তাও লাভবান হবেন।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, এক কেজি পটোল উৎপাদনে চাষির খরচ সাড়ে সাত টাকা। স্থানীয় পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ১৪-১৫ টাকায়। ঢাকার কাওরান বাজারে পাইকারিতে দাম পড়ে মানভেদে ৩৫-৪০ টাকা। আর খুচরা বাজারে সেই পটোল কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হয় ৭০-৮০ টাকা পর্যন্ত।

হাত বদলে পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের ফারাক শুধু পটোলে নয়, প্রায় সব সবজিতেই। শুধু পাইকারি ও খুচরা বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে দাম বাড়ছে কয়েকগুণ। এছাড়া রয়েছে অস্বাভাবিক পরিবহণ ব্যয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, উৎপাদনকেন্দ্র থেকে বিক্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত দফায় দফায় আড়তদারি (কমিশন) খরচসহ নানা ধরনের ব্যয়।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা উভয়েই ঠকছেন। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। যদি কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রির উপায় থাকত, তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা করতে পারত না। পাশাপাশি রাস্তায় চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি হাটে সবজি বিক্রি করতে আসেন পাশের উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের চাষি হাসান। তিনি বলেন, আমি গত বছরের মতো এবারও তিন বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেছি। ২৫ টাকা কেজিতে বেগুন ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। সবজি বিক্রি করে এখন উৎপাদন খরচই উঠছে না। কিন্তু ঢাকায় শুনছি প্রায় ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর নয়াবাজারে সবজি কিনতে আসা ইবরাহিম বলেন, বাজারে সব ধরনের সবজি আছে। কিন্তু দাম অনেক বেশি। বিক্রেতারা বাড়তি দরে বিক্রি করছেন। কেনার উপায় নেই। বাজারে যদি সংকট থাকত, তা হলে মানা যেত। কিন্তু সংকট নেই। দাম বেশি। তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সবজি কিনতেও কষ্ট হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাজারে সবজির কোনো সংকট নেই। তবে দাম একটু বেশি। দাম কেন বেশি তা খতিয়ে দেখা হবে। সেক্ষেত্রে অনিয়ম পেলেই শাস্তির আওতায় আনা হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button